আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন, এই দিবসে বাঙালীরা বিপন্নবােধ করছে

আমি ১৯-এ দেখি ২১, ২১-এ দেখি ১৯, জানাই হাজার কুর্নিশ, মিলে মিশে এপার ওপার, দিন দিন একাকার 
অমল গুপ্ত,  গুয়াহাটি : 
১৯৫২ সালের আজকে ২১ ফেব্রুয়ারী, বাংলাভাষা রক্ষার তাগিদে ঢাকার রাজপথে প্রাণ আহুতি দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, বরকতরা৷ তার আগে ১৯৬১ সালের ১৯ মে’বরাক উপত্যকার শিলচর শহরে একজন যুবতীসহ ১১জন যুবক পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন সেই একই মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। বাংলাভাষা রক্ষা। 
তাই আজ ২১-এ ফেব্রুয়ারী, বাংলাদেশ-অসমেৰ ভাষা শহীদদের স্মরণে লামডিং এর বিশিষ্ট কবি প্রদীপ সেন গুপ্ত ফেসবুকে পােষ্ট করে লিখেছেন—‘আমি ১৯-এ দেখি ২১, ২১-এ দেখি ১৯, জানাই হাজার কুর্নিশ, মিলে মিশে এপার ওপার, দিন দিন একাকার। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন আজ বিশ্বের দরবারে স্বীকৃতি লাভ করেছে। রাষ্ট্রসংঘের ইউনেস্কো ২১ এ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘােষণা করেছে, এই দিনটি সাড়া বিশ্বের মাতৃভাষা প্ৰেমী মানুষ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে উদযাপন করে থাকে। আজ বাংলাদেশের ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে শহীদ স্মারক কেন্দ্র ‘সাবার’ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে মর্যাদা ও গাম্ভীৰ্যতার সঙ্গে দিনটি পালন করা হয়। ১৯৫২সালে ২১-এ ফেব্রুয়ারী সালাম, রফিক, বরকতরা মায়ের ভাষা রক্ষায় প্রাণ দিয়েছিলেন, কিন্তু বড় দুঃখ ও পরিতাপের কথা দেশ ভাগেরবলি, ঐতিহাসিক বিভিন্ন কারণে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বা অন্য কারণে এ রাজ্যে আসা লক্ষ লক্ষ ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগােষ্ঠীর মানুষ এক টুকরাে জমির হাতছানি, রাজনৈতিক নিরাপত্তার স্বার্থে মায়ের ভাষা বাংলাভাষা ত্যাগ করে অসমীয়া ভাষা গ্রহণ করেছিল। 
পরিবেশ পরিস্থিতি হয়তাে বাধ্য করেছিল, রাজনৈতিক অধিকার, বা ভূমির অধিকার পাওয়ার থেকেও মাতৃভাষা ত্যাগ করাটা কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে একাংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। সাত-আট দশক পরেও রাজ্যের জাতীয়তাবাদী শিবির মাতৃভাষা ত্যাগ করা ‘অসমীয়া ভাষী’ মুসলিমদের মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি। আজও তাদের ‘পামুয়া মুসলিম’, বাংলাদেশী’ প্রভৃতি অপমানকর তকমা সেঁটে দেওয়া হয়। মাতৃভাষা ত্যাগ করে অন্য ভাষা গ্রহণ করার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসেই বিরল। আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে সেই কথায় বলছিলেন রাজ্যের বিশিষ্ট সাংবাদিক দিগন্ত শৰ্মা। বিশ্ব কাঁপানাে নেলীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড, লাওখােয়া প্রভৃতি জায়গার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তথ্য মূলক গ্রন্থ লিখেছেন সাংবাদিক দিগন্ত শৰ্মা। সাপ্তাহিক সাদিন-এর সাংবাদিক শৰ্মা আজ মাতৃভাষা দিবসের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সব মাতৃভাষার কথায় উল্লেখ করা হয়েছে। অসমীয়া, বাঙালী, বড়াে প্রভৃতি সব ভাষার কথায় বলা হয়েছে। কিন্তু ব্ৰহ্মপুত্ৰ উপত্যকায় মাতৃভাষা বলতেই একাংশ মানুষ অসমীয়া ভাষাকেই বােঝায়, বড়াে সাহিত্য সভার সভাপতি বিনেশ্বর ব্ৰহ্ম বড়ােভাষার লিপি রক্ষা করতে গিয়ে দুস্কৃতিদের হাতে নিহত হলেন, তার কথা কেও জানে না। 
বরাক উপত্যকায় একজন যুবতীসহ ১১ জন যুবক বাংলাভাষা রক্ষায় প্রাণ দিলেন, তাদের আজ পর্যন্ত সরকার স্বীকৃতিও দিলাে না। তা বড় লজ্জার কথা। শিলচর রেলওয়ে স্টেশনকে ভাষা শহীদ ষ্টেশন হিসাবে স্বীকৃতি জানানাের প্রস্তাবকেও ঝুলিয়ে রাখা হলাে। নিজেদের সন্তানকে মাতৃভাষা শেখানাে, পরিবারের মধ্যে রেখে শিশুকে মাতৃভাষার মাধ্যমে পরিচর্যা ও লালন পালন করার মধ্যে দিয়েই মাতৃভাষা রক্ষার অধিকার জন্মায়। রাজ্যের বিশিষ্ট সাহিত্যিক পদ্মশ্রী জয়শ্রী গােস্বামী মহন্ত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা করে বলেন, ভূমিষ্ট হওয়ার পর সন্তানরা আকারে ইঙ্গিতে মায়ের ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে। সেই ভাষাকেই স্বীকৃতি জানানাে উচিত। ফরাসিরা ফরাসি ভাষায়, বিট্রিশরা ইংরাজী ভাষায়, অসমীয়ারা অসমীয়া ভাষায়, বাঙালীরা বাংলাভাষায় কথা বলে, তাই স্বাভাবিক। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সব জনগােষ্ঠির মাতৃভাষার কথায় বলা হয়েছে। মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। এই ভাষা পরিচর্যার মাধ্যমে সন্তানরা জীৱনে উন্নতির শিখরে উঠতে পারে। ভাষা উন্নতির সােপান। 
মাতৃভাষার জন্য যারা প্রাণ আহুতি দিয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন পদ্মশ্রী জয়শ্রী গােস্বামী মহন্ত। রাজ্যে এক বৃহৎ সংখ্যক বাংলাভাষী মানুষের বাস, প্রায় ১ কোটি হিন্দু-মুসলিম মানুষ বাংলাভাষায় কথা বলেন। বরাক উপত্যকায় লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর ত্রি-ভাষার সূত্র অনুযায়ী বাংলাকে প্রধান ভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু নানা কারণে এবং বরাকব্রহ্মপুত্ৰে এক বৃহৎ সংখ্যক মানুষ বিদেশী ভাষা ইংরেজির প্রতি অত্যন্ত মােহ থাকার জন্য তাদের সন্তানদের কেরিয়ার গড়ার লক্ষ্যে ইংরাজী মাধ্যম বিদ্যালয় গুলিতে পড়াশুনার জন্য পাঠাচ্ছে।
রাজ্যের শতাধিক বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদের অভাবে যুঁকছে, তা ছাড়া ব্ৰহ্মপুত্ৰ উপত্যকার বেশ কিছু প্রাথমিক, মধ্যইংরাজী, বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়কে অসমীয়া মাধ্যম বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়েছে। বাংলাভাষা আজ বিপন্নপ্রায়, শুধু অসমেই নয় প্রতিবেশি রাজ্য পশ্চিম বংঙ্গেও বাংলাভাষার প্রতি অনিহা কেরিয়ার গড়ার লক্ষ্যে ইংরাজী ভাষার মােহে আছন্ন। বাংলাদেশ এবং বরাক উপত্যকার শহীদরা কি বাংলাভাষা রক্ষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েও ন্যায্যতা পাবেনা? তাদের জীৱন কি বৃথায় যাবে?

SHARE THIS

No. 1 Web Media in North-East India. Maintained and Published by Saiyad Bulbul Jamanur Hoque on behalf of Save Media Solution (A unit of SAVE).

0 comments: