🔹 অমল গুপ্ত
ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদ, পলাশির প্রান্তর, পবিত্ৰ নদি গঙ্গার কিনার থেকে এসে আজ দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় মা কামাখ্যা-ব্ৰহ্মপুত্র নদের পূণ্যভূমির আশীর্বাদ ধন্য মানুষ। জীবন জীবিকার তাড়নায় আমাকে কামাখ্যার নিলাচল পাহাড়ের অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের অপাের সৌন্ধর্যের কোলে মনােরম পরিবেশের শহর গুয়াহাটি, আদি প্ৰাগজ্যোতিষপুরে থিতু হতে হয়েছে। চার পাশের সবুজ পাহাড় ঘেরা জঙ্গল, ব্ৰহ্মপুত্রের মতো দীর্ঘতম নদ, ডলফিন, বাঘ, বন্যজন্তু, প্রাকৃতিক জৈব বৈচিত্রের শহর গুয়াহাটির ‘আপাতত’তে সস্ত্রীক ডেরা বেঁধেছি। সাংবাদিকতা আমার পেশা। কিন্তু জীবিকা নয়। আমার নেশা দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ জঙ্গল, মনােরম প্রাকৃতিক পরিবেশ। তার সঙ্গে অবশ্যেই আমাদের চারপাশের আত্মকেন্দ্ৰিক স্বার্থপর মানুষ। সাংবাদিকতা জীবনে স্বার্থপর মানুষের আকাশ সমান লোভ, কুট-কৌশল, রাজনৈতিক নোংরা খেলা দেখাৰ সৌভাগ্য বা দুৰ্ভাগ্য হয়েছে। যার সঙ্গে রাজ্যের লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবি, সরল গরিব মানুষের কোনও সম্পর্ক নেই। আকাশ সমান মূল্যবৃদ্ধি, আকাশ স্পর্শকরা মানুষের লোভ এবং হৃদয়হীন মানুষের ভিড়ে গরিব আম জনতার নাভিঃশ্বাস উঠছে।
সততা, ন্যায়— পৰায়ণতা, মূল্যবােধ, মানবতাবােধ আজ বস্তাপচা শব্দে পর্যবসিত হয়েছে। দীর্ঘ বিস্তৃর্ণ সবুজ বাঁশবন, শাল-সেগুন, ছাতিম-জারুল, বিপন্ন প্রজাতির এক শৃংগ বিশিষ্ট গণ্ডার আমাকে টানে। কাজিরঙার জীবন্ত গণ্ডারের খড়গ কেটে চােরা শিকারিরা পালাচ্ছে। রক্তাক্ত গণ্ডারের ছট্ফটানি আমাকে কাঁদায়। জাটিংগা পাহাড়ের আত্মঘাতী পাখিরা স্ব-ইচ্ছায় আগুনের লেলিহান চিতায় জাঁপ দিচ্ছে, তা আমাকে ভাবায়। হিটলারের কনশেনট্রেশন ক্যাম্পের মতো এ রাজ্যের ডিটেনশন ক্যাম্পে বিনা বিচারে অন্ধকার কুঠুরিতে কমলা, জাহান নেসারা মনুষ্যতের জীবন-যাপন করছেন। তা আমার মনকে বেদনায় ভারাক্রান্ত করে। আমি ভাবি এই কী আমাদের স্বাধীন ভারতবর্ষ ? নিন্ন অসমের কয়েক হাজার চরাঞ্চলের লক্ষ লক্ষ সংখ্যালঘু মানুষ এক অভাবণীয় যন্ত্রনাময় জীবন-যাপন করছে। সরকারের নূ্যনতম সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
দীর্ঘ ৫০–৬০ বছর এরাজ্যে বসবাস করার পরেও বাংলাদেশী তকমা তাদের ভবিতব্য। বাৎসরিক বিধ্বংসী বন্যায়। তাদের ঘর-বাড়ী সব ধুয়ে মুছে যায়। বানভাসি গরিব মানুষগুলো শুধুই ঠিকানা বদল করে। শেষ পর্যন্ত তাদের ঠিকানা হয়ে দাঁড়ায় গুয়াহাটি মহানগরী। এই তথাকথিত “বাংলাদেশী” মানুষগুলো গুয়াহাটি মহানগরকে গড়ছে, ভাঙছে। তাই সুৰম্য প্রাসাদে ভরে উঠেছে। গুয়াহাটি। সেই মানুষগুলির কিন্তু কোনও মূল্য নেই। গুয়াহাটিতে আমাদের কাজের মেয়ে সংখ্যালঘু গরিব ঘরের মেয়েরা। প্রয়োজন ফুরালেই দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিই। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর অসম। বিশ্ব পর্যটন মানচিত্রে স্থান করে নেওয়ার মতো নানা বৈশিষ্ট্য এরাজ্যে আছে। এশিয়ার বৃহত্তম নদিদ্বীপ মাজুলি, শ্ৰীমন্ত শংকর দেবের স্মৃতি বিজড়িত মাজুলি সত্রীয় সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিত। অসমের বিহু নৃত্যও বিশ্বে সমাদৃত হচ্ছে। অসমের এক শৃংগ বিশিষ্ট গণ্ডার রাজ্যকে বিশ্বের কাছে পবিচয় করিয়ে দিয়েছে। মিশরের পিরামিড দেখতে মানুষ ছুটে যায়, কিন্তু অসমে শিবসাগর জেলার চরাইদেউয়ের মাটির স্তুপ দেখার জন্য বিশ্বের পর্যটকরা যাননা, জানেওনা।
আহােম রাজত্বের রাজা মহারাজাদের সমাহিত করা হত সেই সব স্তুপের মাঝে।
সেই মাটি খুড়ে আজও রাজা-মহারাজাদের সোণালি ইতিহাস, তাদের ব্যবহৃত স্বৰ্ণালংকার, আসবাবপত্র, পোষাক-পরিচ্ছন্দ পাওয়া যাচ্ছে। যা বর্তমানে জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়ার তত্বাবধানে সংরক্ষিত হয়ে আছে। দাৰ্জিলিঙের টয়ট্রেন চড়তে মানুষ ছুটে যান। কিন্তু লামডিংশিলচরের পাহাড় লাইনের প্রাকৃতিক সৌন্দৰ্য্যের যে হাতছানি তাকে কেউ অগ্রাহ্য করতে পারবেনা। কেবল মাত্র সরকারের অবহেলা-অনাদরের জন্য পাহাড় লাইনে কোনও পরিকাঠামো নেই। উত্তরপূর্ব সীমান্ত রেলওয়ে জটিংগা-হাফলং-মাহুর মিটারগেজ লাইনের প্রায় একশো কিলোমিটার পরিত্যাগ করে ব্রডগেজ লাইন নির্মাণ করায় পাহাড়ের সৌন্দৰ্য্য ধ্বংস হয়ে গেছে। শত বছরের প্রাচীন ৩৭ ট্যানেলের মধ্যে ১০ টি ট্যানেল বাদ দিয়ে ব্রডগেজ নির্মাণ করা হয়েছে। পরিত্যক্ত প্রায় একশো কিলোমিটার মিটারগেজ লাইনে দাৰ্জিলিঙের মতােটয়ট্রেন চালিয়ে সরকার। ৰাজস্ব বৃদ্ধি করতে পারতাে। অসমের ভূ-গর্ভে কয়লা, গ্যাস, তেল প্রভূতির অফুরন্ত ভাণ্ডার। উজান অসমে ভূ-গৰ্ভস্থ গ্যাস ২৪ ঘণ্টায় জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। সেই বহু মূল্যবান গ্যাস ব্যবহারের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মাৰ্ঘেরিটার ওপেন কষ্ট কয়লার অফুরন্ত ভাণ্ডার। সেই কয়লায় সালফার থাকার জন্য বিদ্যুৎ প্রকল্পে ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
সামান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেইসালফার বিযুক্ত করা যেতে পারতো। বঙ্গাইগাওয়ের বৃহৎ আয়তনের তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্পের কয়লা বাইরের রাজ্য থেকে আমদানি করা হচ্ছে। চীন-তিব্বত, হিমালয়ের উৎস থেকে ২৯০৬ কিলোমিটার ব্ৰহ্মপুত্র নদ প্রবাহিত হয়েছে। যা অসমের জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংগ। চীনের ধ্বংসাত্মক ‘হুয়াংহাে’ নদী নিয়ন্ত্রণ করে চীন সরকার অর্থনীতিকে স্বচ্ছল করে তুলেছে। আর অসমে প্রতি বছর ব্ৰহ্মপুত্রের ভয়াবহ বন্যায় রাজ্যের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই প্রথম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোণোয়াল নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ব্ৰহ্মপুত্ৰ খননের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা যদি সত্যিই বাস্তবায়িত হয়, তবে রাজ্যের আর্থিক অবস্থা আমূল পরিবর্তন ঘটবে। রাজ্যে পিক আওয়ারে ১৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা। কিন্তু নিজস্ব উৎপাদন মাত্র ৩০০ মেগাওয়াট। ব্ৰহ্মপুত্রের অঢেল জলরাশি সদ্ব্যবহার করা হলে অসমের বিদ্যুৎ চিত্র আমূল পাল্টিয়ে যেত।
রাজ্যের ৮০০ বেশি চা বাগানে দেশের ৬০ শতাংশ চা উৎপাদন করে, নানা সমস্যায় জর্জরিত চা বাগান। যথাযথভাবে সদ্ব্যবহার করা হলে রাজ্যের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতো। এ ছাড়াও অপাের বনজ সম্পদ, ঔষধি গাছ-গাছড়া, বিভিন্ন প্রজাতিৰ অৰ্কিড, প্রজাপতি, কাজিরঙার এক শৃংগ বিশিষ্ট গণ্ডার, সাদা ডানার বুনো হাঁস, ডিব্ৰু-সাইখোয়া অভয়ারণ্যের বুনাে ঘোঁড়া, মানসের ব্যাঘ্র প্রকল্প প্রভৃতি অফুরন্ত জৈব বৈচিত্র, শুয়ালকুছির মুগা সিন্ধ, সৰ্থেবারির কাসা শিল্প প্রভৃতি অসমকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। অসম সরকার ১০ কোটি বৃক্ষ রোপনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। কিন্তু বৃক্ষ রোপন হলেও তা সংরক্ষণের বড় অভাব। আমারই লেখা “বনে বনান্তরে” শীৰ্ষক গ্রন্থে দেশের অন্যতম স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবী পান্নালাল দাসগুপ্ত গত ২০১৫ সালের ২৪শে মে’তে তার “ভূমিকায় লিখে গেছেন– “আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল তার বন সম্পদ।
মানুষের লোভে সেই বন সম্পদকে বোপেরোয়াভাবে উজাড় করে ফেলছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এর জন্য কি মূল্য দিতে হবে, সে কথা এখন কেউ চিন্তাও করেনা। বনসম্পদ ধ্বংস করার অন্যতম কুফল হলো বৃষ্টিপাতের পরিমান কমে যাওয়া এবং ভূমিক্ষয়। গত কয়েক বছর ধৰে আমি আসামের সরকারীবেসরকারী নেতাদের বনজ সম্পদ ধ্বংসের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে বলে আসছি। আকাশ থেকে বীজ ছিটিয়ে (এৰিয়্যাল সিডলিংক) বন সৃজন করার প্রস্তাব আমি দিয়ে ছিলাম।” আমাৰ পরিবেশ প্রকৃতি বিষয়ক দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘অসমের রবীন আঙ্কলার নায়ক এবং প্রকৃতি প্রেমী রবীন ব্যানাজীর এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। পিপল ফর আ্যনিমেলসের কর্ণধার সংগীত গোস্বামী তার ভিডিঅ’গ্ৰাফী করেছিলেন। সেই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে রবীন ব্যানাজী বলে গেছেন— “কাজিরাঙাকে আর বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখা যাবেনা। মানুষের লাগাম ছাড়া লোভের বলি হবে কাজিরাঙাকে।
এই প্রকৃতি প্রেমী ব্যানাজী ৬০ দশকে কাজিরঙার এক শৃংগ বিশিষ্ট গণ্ডারের ছবি বার্লিন টেলিভিশনে দেখিয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন। তার পরই কাজিরঙকে রাষ্ট্ৰীয় উদ্যান হিসেবে স্বীকৃতি জানানো হয়। ২৬৩ কিলোমিটার অসাম-বাংলাদেশ সীমান্তের ৬১ কিলোমিটারে জল ও স্থল সীমান্ত আজও সীল করা হলো না। আজও বাংলাদেশী ইসু ছাড়া রাজ্যের রাজনীতিকদের রাজনীতি হয়না। অসমের থেকে চারগুণ বেশি ৮৫৬ কিলোমিটারের সীমান্তরাজ্য ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারকে এই প্রতিবেদক জিজ্ঞাস করেছিল—আপনাদের কোনও বাংলাদেশী সমস্যা নেই? জবাবে মানিক সরকার বলেছিলেন— “বাংলাদেশী সমস্যা একমাত্র অসমেই আছে। দেশের কোনও রাজ্যে নেই। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশীরা ত্রিপুরায় আসে, দিনভোর পরিশ্রম করে, আবার ফিরে যায়।
আমাদের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। সে ক্ষেত্রে আমরা লাভবান হই।” অসমে বরাক-ব্ৰহ্মপুত্র উপত্যকার মধ্যে নানা টানা পোড়েন চলছে। একাংশ জাতীয়তাবাদী শক্তি নানাভাবে উস্কানিমূলক কান্ড-কর্ম করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিষিয়ে তুলছে। আজও লাওখোয়া, নেলী প্রভৃতি জায়গায়ৰ মতো বিশ্বকােপানাে হত্যাকাণ্ড অনেকের স্মৃতিতে অস্নান হয়ে আছে। তার পরেও জাতীয়তাবাদী চক্র, অশুভ দেশবিরোধী শক্তিকে সঙ্গী করে আস্ত্রের ঝন-ঝনানি শুনাচ্ছে। তাই আজান ফকির, শংকর দেবের সম্প্রীতির রাজ্যে আজও রাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষ অজানা-আশংকায় আতংকিত হয়ে থাকে।
এত কিছু লিখে আপনাদের বিরক্তি বাড়ানোর একটিই কারণ। অসমে এত সম্পদ থাকার পরও তা সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। আমরা আত্মকেন্দ্ৰিক স্বার্থপর মানুষরা আজও সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি, ভাতৃত্ববােধে উদ্ধৃদ্ধ হয়ে অসমকে উচ্চাসনে নিয়ে যেতে পারছিনা।
ফোন : +91 9864044239
0 comments: