গুজরাট মডেল : গ্রামে কাজ করেনি মোদী ম্যাজিক

লক্ষ্য মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরা, কর্ণাটক নির্বাচন : গ্রামের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে কৃষিজীবী মানুষদের উন্নয়নে বিশেষ জোর দেওয়ার ইঙ্গিত 

অমল গুপ্ত, গুয়াহাটি : 
গুজরাট মডেল, গুজরাট মডেল, গুজরাট মডেল...। শুনতে শুনতে কাণ ঝালা-ফালা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অগ্নি পরীক্ষায় সেই মডেল ম্যাজিক দেখাতে পারলো না। সদ্য বিধানসভা নির্বাচনে পোষ্টমর্টেমের বিভিন্ন সংখ্যাতত্ব থেকে জানা যাচ্ছে, গুজরাট মডেল গ্রাম গুজরাটে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে। অভিযোগ উঠেছে গুজরাটের ভোটারদের কাছে মোদী প্রধানমন্ত্রীর পদের মর্যাদা খুঁইয়ে, বিকাশ ভুলে, হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণের রাজনীতি করলেন। মনমোহন সিংদের পাকিস্তানের চর বলা হলো, রাহুল গান্ধীকে বাবরের বংশধর থেকে ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে তুলনা করা হলো। তাতে বােঝাই গিয়েছিল, সাম্প্রদায়িকতায় মোদী, অমিত শাহের রাজনীতির তাস। জিএসটি-তে যত না ধাক্কা খেয়েছে শহর, তার থেকে নোট বাতিলে অনেক বেশি ধাক্কা লেগেছে গ্রামে। গ্রামাঞ্চলের অসংগঠিত গরিব শ্রমিকেরা কাজ হারিয়েছেন। স্বচ্ছল শহর মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আহমেদাবাদ, সুরাট, বডোদরা, রাজকোট প্রভৃতি ঝাঁ চকচকে শহরের কাছে ভিতেই গ্রামগুলোর রুগ্ন চেহারা, স্বাস্থ্য-শিক্ষা, পানীয় জল, বেকারি, কৃষি ব্যবস্থা প্রভৃতি ক্ষেত্রে তথাকথিত গুজরাট মডেল সফল হতে পারেনি। ১৮২ টি আসনের মধ্যে গুজরাটের শহরাঞ্চলে বিজেপি পেয়েছে ৩৬ টি আসন। গ্রামাঞ্চলে পেয়েছে ৬৩ টি আসন। সেক্ষেত্রে কংগ্রেস গ্রামাঞ্চলে পেয়েছে ৭১ টি আসন, শহরাঞ্চলে মাত্র ৬ টি। আর এস এস নেতৃত্ব কৃষক এবং গ্রামীণ মানুষের দুর্দশা, ক্ষোভ, প্রশমনের জন্য ব্যবস্থা নিতে বললেও গুজরাট মডেল গ্রামগুলিতে পৌঁছায়নি। নাগপুরের নির্দেশ মেনে কাজ হচ্ছে না। আর এস এস প্রধান মোহন ভাগবতের পরামর্শ মানছেন না নরেন্দ্ৰ মোদী-অমিত শাহরা। তাছাড়া বৃহৎ পুঁজি ও শিল্পপতিদের সঙ্গে মোদী সরকারের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে। সেই ধরণের সম্পর্ক গ্রামাঞ্চলের গরিবদের ক্ষেত্রে তৈরী হয়নি বলে সঙঘ পরিবার থেকে অভিযোগ উঠেছে। তাই আগামী মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরা, কর্ণাটক প্রভৃতি রাজ্যের নির্বাচনে গ্রামের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হবে। কৃষিজীবী মানুষদের উন্নয়নে বিশেষ জোর দেওয়া হবে। দুনীতি বিরোধী আন্দােলনের নেতা আন্না হাজারে গুয়াহাটিতে অভিযোগ করে গেলেন, দেশের কৃষকদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। গত ২২ বছরে ১২ লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছে। তাই আসন্ন বাজেট অধিবেশনে কেন্দ্রীয় সরকার গ্ৰামমুখী বাজেট প্রস্তুত করার জন্য তৈরী হচ্ছে বলে অর্থমন্ত্রী অরুণ জোঁটলি ইঙ্গিত দিয়েছেন। গুজরাটে কংগ্রেস ৭৭ টি আসন পেয়েছে। ১৬ টি আসনে মাত্র ৩ হাজারের কম ভোটের ব্যবধানে হেরেছে। শঙ্কর বাঘেলার নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসীরা ০.৩ শতাংশ, এবং শরদ পাওয়ারের এন সি পি ০৬ শতাংশ ভোট নিয়ে বিজেপিকে সুবিধা করে দিয়েছে। দলিত ভোটে ভাগ বসিয়েছে মায়াবতীর বহুজন সমাজ পাৰ্টী।
নরেন্দ্ৰ মোদীর গুজরাটের ভডনগরের এক রেল ষ্টেশনে চা বিক্ৰী করে প্রধানমন্ত্রী গদিতে বসেছেন। সারা বিশ্বে নজর কেড়ে শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। সেই গুজরাটের মেহসানা জেলার দুটি বিধানসভা কেন্দ্র খেরালু আর উনঝা। খেরালুতে বিজেপি জিতেছে, কিন্তু উনঝাতে কংগ্রেসের আশাবেন দ্বারকা দাস প্যাটেল পাঁচবারের বিজেপি বিধায়ককে হারিয়েছেন। রাজ্যের পাতিদার আন্দোলনের নেতা হার্দিক প্যাটেল, দলিত আন্দোলনের নেতা জিগ্নেশ মেবানির এবং ওবিসি আন্দােলনের নেতা অল্পেশ ঠাকোর, এই তিন যুব নেতা কংগ্রেসের যুব নেতা রাহুল গান্ধীর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে লড়াই করে মোদী-শাহর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন। অত্যন্ত জনপ্রিয় যুব নেতা হার্দিক প্যাটেল এখনও হার স্বীকার করতে রাজি নন। তিনি গুরুতর অভিযোগ করে বলেছেন, বিজেপি আহমেদাবাদ থেকে ১৫০জন সফটওয়ের ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়ে এসেইভিএম মেশিনগুলি টেম্পারিং করেছেন। 
কংগ্রেস নেতৃত্ব কিন্তু একবারও ইভিএম টেম্পারিং-এর কথা বলেনি। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানী নির্বাচনের প্রধান মুখ ছিলেন না। প্রধান মুখ ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্ৰ মোদী। তিনি প্রায় ৪০ টি জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। উন্নয়নের ইস্যু ছেড়ে অন্যান্য চমকদারি ও আবেগিক ভাষণে জোর দিয়েছিলেন। বিজেপি ৯৯টি আসন পেয়ে ৪১.৬ শতাংশ ভোট অর্জন করেছেন। অপরদিকে কংগ্রেস ৭৭টি আসন পেয়ে ৪১.৪ শতাংশ ভোট অর্জন করেছেন। বিগত নির্বাচনে বিজেপি ১১৫ টি এবং কংগ্রেস ৬১ টি আসনে জয়লাভ করেছিল। গুজরাটে নৈতিক জয় হয়েছে বলে বিজেপি দাবী করলেও সেই রাজ্যে ৫,০০,৫১৪ টি নোটা ভোট পড়েছে। যার শতাংশ ১.৮ শতাংশ। যারা কোনও দলকেই পছন্দ করে না। কংগ্রেস রাজত্বের হিমাচল প্রদেশে বিজেপি ৪৪ টি আসন পেয়েছে। সেখানে কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ২১ টি আসন। হিমাচল প্রদেশে নোটা ভোটের সংখ্যা ৩৩,৬৬৩ টি। হিমাচল প্রদেশে বামপন্থী দলের একজন মাত্র প্রাৰ্র্থী জয়লাভ করেছেন। 
দেশের ১৯টি রাজ্যে বিজেপি শাসনে আছে। আগামী ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন। সেদিকে লক্ষ্য রেখে প্রধানমন্ত্রী বুধবার গুজরাট নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ তুলে ধরে নির্বাচনের জয়লাভকেই একমাত্র অস্ত্র বলে পিছনের দিকে আর তাকাতে চান নি। আগামী লোকসভা নির্বাচনে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করে তৃণমূল পর্যায় থেকে ঝাঁপিয়ে পরে যুব সম্প্রদায়কে পাশে নিয়ে কংগ্রেস মুক্ত ভারত গড়ার লক্ষ্যে বিজেপির বিজয় রথ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী গুজরাটের নির্বাচনের ফলাফলে উজ্জীবিত হয়ে বলেছেন, তারা গুজরাটে জনগণের উন্নয়নের স্বার্থে লড়াই করেছেন, তা আক্ৰোশমূলক ছিল না। তিনি বলেন মোদীর “গুজরাট মডেল’ গুজরাটবাসীরা মেনে নেন নি বলে মন্তব্য করে বলেছেন— “তবে মোদীর বিপণন খুব ভালো। কিন্তু তা ভিতরে ফাঁপা।” দেশের বামপন্থী আন্দােলনের নেতা সীতারাম ইয়েচুরি দেশের বর্তমান অবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, দেশের গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে আরও শক্তিশালী করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হবে। সাম্প্রদায়িক এবং বিভেদকামী শক্তিকে পরাভূত করতে হবে।

SHARE THIS

No. 1 Web Media in North-East India. Maintained and Published by Saiyad Bulbul Jamanur Hoque on behalf of Save Media Solution (A unit of SAVE).

0 comments: