সুপ্রিয়া দেবী – বাংলা চলচ্চিত্রের নাটকীয় রানি

  • জ্যোতিষ কুমার দেব 

 চলে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের সোফিয়া লোরেন সুপ্রিয়া দেবী (চৌধুরী) যাঁর জন্মনাম ছিল কৃষ্ণা ব্যানার্জী। বাংলা অভিনেত্রীদের মধ্যে অনন্ত যৌবনা অনন্যা যিনি শেষ অবধি তাঁর দৈহিক সৌন্দর্য, মুখাবয়ব সর্বোপরি যাদুকরী আকর্ষণকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর সৌন্দর্যের আকর্ষন ও যৌবনের উচ্ছলতা যেন উছলে পড়ত সিনেমার বিশেষ করে রূপোলি পর্দায়। তাঁর দৈহিক গঠন, এক ঢাল কৃষ্ণ কেশ, চাঁদের হাসির বাঁধভাঙা কুন্দশুভ্র টোলফেলা হাসি কৌণিক মুখাবয়ব, গালের উঁচু হনু-হাড়, হরিণ-চক্ষু (যাকে সার্থক ভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছিল ‘মন নিয়ে” চিত্রে “ওগো কাজল নয়না হরিণী” গানে), ঘন ঈষৎ কুঞ্চিত চোখের পাতা, স্ফুরিত অধরোষ্ঠ এবং তাঁর টিপিকাল পরিচায়ক শকিং পিংক লিপস্টিক – সব কিছু তরুণদের মাতল করে তাদের নিদ্রা হরণের জন্য যথেষ্ট ছিল। তবু সমস্ত গ্ল্যামার ও আকর্ষণ সত্বেও তিনি সমকালীন সুচিত্রা সেনের স্টার এপিলের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেন নি তাঁর সেই আসনকে টলানো তো অনেক দূরের কথা! তবে তিনি পরম সৌভাগ্যবতী বাংলা ও ভারতীয় চিত্রজগতের নমস্য ঋত্বিক ঘটকের মতন পরিচালকের মনোনীতা অভিনেত্রী হিসেবে “মেঘে ঢাকা তারা” ও “কোমল গান্ধার” এর মতন ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পাওয়ায়। এ ব্যাপারে পরিচালকের মতন তাঁরও রিফিউজি পরিচয় (তবে পূব পাকিস্তান নয় ব্রহ্মদেশ উদ্বাস্তু) হয়তো সহায়ক হয়েছে। 
 সুপ্রিয়া খুব উঁচু দরের বা প্রতিভাময়ী অভীনেত্রী ছিলেন না। তাঁর দক্ষতা ছিল নাটকীয় চরিত্রায়নে। এই ক্ষেত্রেও তাঁর সৌভাগ্যকারক রূপে পেয়েছেন সহ-অভিনেতা হিসেবে মহানায়ক উত্তম কুমারকে। যার দৌলতে তিনি পেয়েছেন “বসু পরিবার” “শুনো বরনারী” “বিলম্বিত লয়” “চৌরঙ্গী” “কাল তুমি আলেয়া” “বন পলাশীর পদাবলী” “মন নিয়ে” “সব্যসাচী” “সন্ন্যাসী রাজা” র মতন অসংখ্য ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ। সুপ্রিয়া রীতিমত প্রথাগতভাবে শেখা নৃত্যশিল্পী হওয়ায় বহু চিত্রে তিনি নাচিয়ে নায়িকার চরিত্র পেয়েছেন যেমন “মন নিয়ে” “দেবদাস” ইত্যাদি। তাঁর নৃত্যদক্ষতার সর্বশ্রেষ্ঠ রূপায়ন হয়েছে বাংলা “আম্রপালী” ছবিতে – যে ভূমিকা পরে হিন্দিতে রূপায়ন করেন বৈজয়ন্তীমালা। 
সুপ্রিয়া দেবী কেরিয়ারের মধ্যগগনে থাকাকালীন ভাগ্য পরীক্ষা করেন কয়েকটি হিন্দি ছবিতে । তিনি পেয়েছেন সহযোগী হিসেবে ধর্মেন্দর মতো নায়ক কে “বেগানা” ও “আপ কী পরছাইয়া” চিত্রে ও কিশোর কুমার কে “ দূর গগন কী ছওঁ মে” চবিতে। তবে তাঁর এ প্রয়াস বিশেষ সফল হয় নি। অনেক বাঙালি অভিনেত্রীর (শর্মিলা রাখী) তিনি কোনো ছাপ রাখতে সক্ষম হন নি। এমন কী সুচিত্রা সেনের বিরল কিছু চিত্রের মাধ্যমে কিংবদন্তী হওয়াটাও তার ভাগ্যে জোটেনি। হয়তো এক্ষেত্রে তাঁর টিপিকাল বাঙালি ধরণধারন, রক্ষণশীলতা ও উচ্চারণ সমস্যা প্রতিবন্ধক হয়ে থাকবে। কাজেই হিন্দী ও সর্ব ভারতীয় চিত্রজগতে কেউ তাঁকে স্মরণে রাখে নি( সন্ধ্যা রায়ের মতই)! যা বাংলা চলচ্চিত্রের পক্ষে মঙ্গলদায়ক হয়েছে। 
 সুপ্রিয়ার অবাঙালিসুলভ শারিরীক উচ্চতা আক্ষরিক ভাবেই সমকালীন বাঙালি অভিনেত্রীদের (মাধবী সন্ধ্যা সাবিত্রী কাবেরী অঞ্জনা) বিপরীতে উচ্চতায় থাকার সহায়ক হয়েছে। তাঁর দীঘল দেহ, কৌণিক মুখায়বের জন্য তিনি সকল ধরণের পোষাক পরিধানেএ সমকালীন সাধনার মতন স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল দেখাতেন । এক্ষেত্রেও তিনি স্টাইল আইকন সুচিত্রাকে টেক্কা দিতে পারেন নি! সুপ্রিয়ার কণ্ঠস্বরের বেরিটোন তাঁকে নাটকীয় চরিত্রায়ন ও সংবাদ প্রক্ষেপনে কিছু অতিরিক্ত গুরুত্ব ও ব্যাক্তিত্ব আরোপনে সহায়ক হয়েছে। তাঁর সংলাপ প্রক্ষেপনের এই সাবলীলতা তাঁর বয়োবৃদ্ধির সাথে আরো পরিণত হয়েছে। “সাবরমতী” “লাল পাথর” “সিস্টার” “বাঘ বন্দী খেলা” “যদুবংশ” “দুই পুরুষ” চিত্রগুলিতে সুপ্রিয়ার এই দক্ষতা পরিস্ফুট। তিনি এই প্রতিভার বলে উত্তম কুমার অভিনীত এই ছবিগুলোতে মহানায়কের বিপরীতে যথাযোগ্য ভাবে নাটকীয় মুহুর্তগুলোকে জীবন্ত করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর স্বরের এই গভীরতাই “মেঘে ঢাকা তারা” র সেই বিখ্যা সংলাপ “ দাদা আমি মরতে চাইনি আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম “ কে চোখের জলে ভাসা নিছক অতিনাটুকে হওয়া থেকে রক্ষা করেছে। ব্যাক্তিগত ভাবে আমার পছন্দের সুপ্রিয়া অভিনীত ছবিগুলোর তালিকায় রয়েছে “মন নিয়ে” “সিস্টার” “বাঘ বন্দী খেলা”। তাঁর কেরিয৮আরে সবচেয়ে জটিল ভুমিকা করেছেন তিনি “মন নিয়ে” ছবিতে দুই যমজ বোনের চরিত্রায়নে। তিনি “লাল পাথর” ছবিতেও অত্যন্ত সফল। তাঁর উল্লেখনীয় ব্যর্থতা “দেবদাস” চিত্রে চন্দ্রমুখীর চরিত্রায়নে। 


অবাক কাণ্ড – যে চরিত্রের হিন্দী রূপায়নে বৈজয়ন্তীমালা মাধুরী এরা যশ বাহবা পুরস্কার সবই পেয়েছেন তার প্রতি সুপ্রিয়া তার রূপ নৃত্যদক্ষতা নাটকীয় অভিনয় ক্ষমতা সত্বেও সুবিচার করতে পারেন নি (প্রসঙ্গত একই ভাবে আরেক বাঙালি অভিনেত্রী সুচিত্রাও একইভাবে “দেবদাস” এর অপর নায়িকা পার্বতীর চরিত্রায়নে ব্যর্থ অথচ হিন্দী আবার যমুনা ঐশ্বর্য এরা সর্বতোভাবে সফল!)। হয়তো বয়সের অগ্রগতি এর কারণ। পরিবর্তিত সময়ের সাথে সুপ্রিয়া তাঁর নাটকীয় অভিনয় দক্ষতার জন্য সহজেই ও সফলভাবে “জননী” র মত টিভি সিরিয়াল এ অভিনয় করা শুরু করেন। এগুলো ও শেষাবধি “নেমসেক” এর মত চলচ্চিত্রে অভিনয় তাঁকে শেষাবধি অভিনয়ে ব্যাপৃত রাখে। 
 সুদীর্ঘ অভিনয় জীবন জুড়ে অসংখ্য অথরব্যাকড চরিত্র পেয়েও সুপ্রিয়া তাঁর নিজের দক্ষতাকে ছাপিয়ে উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম হলেন না। তাঁর অভিনীত চরিত্র গুলির হিন্দী রূপায়নে চরিত্রাভিনেত্রীরা যেভাবে ঝলসে ওঠেছেন (“লাল পাথর” এ হেমা মালিনী, “হম দোনো” তে সাধনা, “দেবদাস” এ মাধূরী) তা দেখে এই আফশোষ বিশেষ ভাবে জাগে। তবু সান্ত্বনা এর মধ্যেই তিনি দুটো বিএফযেএ, ও একটি ফিল্মফেয়ার, ও বঙ্গ-বিভূষণ ও পদ্মশ্রী পুরস্কার পেতে সফল হয়েছেন তাঁর যোগ্যতার বলে। সর্বোপরি তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছেন শেষ অবধি। তাঁর ৬৫ বর্ষ ব্যাপী সুদীর্ঘ অভিনয় জীবনের যথাবিহিত অবসানের সাথে সত্যিই এক নাটকীয় পরিসমাপ্তি ঘটেছে! তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধঞ্জলি ।

SHARE THIS

No. 1 Web Media in North-East India. Maintained and Published by Saiyad Bulbul Jamanur Hoque on behalf of Save Media Solution (A unit of SAVE).

0 comments: