• সৈয়দ বুলবুল জামানুর হক
মেয়েটির বয়স কত জানেন? মাত্র ৮ বছর। কী হয়েছিল তার সঙ্গে? মন্দিরের মধ্যে ৭দিন ধরে আটকে রাখা হয়েছিল ছোট্ট মেয়েটিকে। ছ'জন মিলে লাগাতার ধর্ষণ করেছিল শিশুটিকে। এতেও শেষ হয়নি, মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে স্থানীয় বিবাদের কড়া মূল্য চোকাতে হয়েছে তাকে। মাথা থেঁতলে খুন করে তার দেহটা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল জঙ্গলের মধ্যে।
এমনকী, বালিকাটিকে বন্দি করার সময় রাস্তা দিয়ে ছেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মন্দির পর্যন্ত।
চলতি বছরের জানুয়ারির এই ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে সরগরম হলেও তারপর সেভাবে আর কল্কে পায়নি ছোট্ট বালিকার বীভৎস পরিণতির খবর। কিন্তু সেই ঘটনা আবার ফিরে এসেছে খবরের শিরোনামে। এবার তার হত্যার দোষীদের শাস্তির দাবিতে গলা তুলল বলিউড। অভিষেক বচ্চন থেকে শুরু করে জাভেদ আখতার, ফারহান আখতার, স্বরা ভাস্কর, অতুল কাসবেকর, হংসল মেহতা, বিশালা দালানি- কে নেই এই প্রতিবাদীদের দলে। বলতে গেলে তামাম বলিউড এখন নেমে পড়েছে 'জাস্টিস ফর কাঠুয়া গণধর্ষণ'- র জন্য।
মধ্যরাতে ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল রাহুলের
পুলিশের গড়া ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল করে এগোচ্ছেন রাহুল গাঁধী। সঙ্গে দুই প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া— নির্ভয়ার বাবা-মা। ওঁদের সঙ্গেই মিছিল ভেঙে এগোচ্ছেন প্রিয়ঙ্কা বঢরা-সুস্মিতা দেব-দিব্যা স্পন্দনারা। হাঁটছেন প্রিয়ঙ্কার স্বামী রবার্ট বঢরা এবং তাঁদের ছেলেমেয়েরা। তাঁদের সঙ্গে আরও জনতা। রীতিমতো ধস্তাধস্তি করেও মিছিল আটকাতে পারল না পুলিশ। তাদের গড়া ব্যারিকেড ভেঙেই মিছিল পৌঁছে গেল ইন্ডিয়া গেটে।
মিছিলে যোগদানকারীদের হাতের মোমবাতির আলোয় তখন উজ্জ্বল হয়ে উঠছে গোটা চত্বর। আর সেখানেই রাস্তার উপর প্রতিবাদ জানিয়ে বসে পড়নে রাহুল। তাঁর দেখাদেখি অন্যরাও।
কংগ্রেস সভাপতি রাহুল সন্ধ্যাতেই টুইট করে জানিয়েছিলেন, নারী নির্যাতন এবং নির্যাতিতাদের জন্য বিচার চেয়ে মধ্যরাতে মিছিল এগোবে ইন্ডিয়া গেটের দিকে। সময় মতোই শুরু হয়েছিল মিছিল। সেই মিছিলে নির্ভয়ার বাবা-মায়ের যোগ দেওয়া অন্য মাত্রা যোগ করে।
কাঠুয়া এবং উন্নাওয়ের ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে এবং নির্যাতিতাদের জন্য বিচার চেয়ে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে মিছিল করেন রাহুল। আর সেই মিছিল ফিরিয়ে দিল ২০১২ সালের ডিসেম্বরে নির্ভয়া গণধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদের আবহ। এমনিতেই নানা ঘটনায় চাপে থাকা নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের কপালের ভাঁজ আরও গভীর করে দেওয়ার জন্য যা যথেষ্ট।
সব মিলিয়ে বৃহস্পতিবার সারা দিনটাই অন্য রকম কাট বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের। রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে ক’দিন আগে কংগ্রেসের অনশনকে টেক্কা দিতে বিপুল প্রচার করে এ দিন পাল্টা অনশনে বসলেও সেটা তেমন জমাতে পারেননি মোদী-অমিত শাহরা। উন্নাও আর কাঠুয়া গণধর্ষণের ছায়ায় সেই অনশন ঢাকা পড়ে যাওয়ার অস্বস্তির মধ্যেই রাহুলের মিছিল।
অথচ এমনটা যে হবে, বিজেপি নেতাদের কল্পনাতেও ছিল না। পাছে কেউ খেতে শুরু করেন, সেই ভয়ে আশপাশের খাবারের দোকান পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়ে তাঁরা অনশন শুরু করেন সকাল থেকে। সেখানে স্লোগান ওঠে, ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনশন করুন’। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যে কখন অনশন শুরু করলেন আর কখন শেষ করলেন— সেটাই তো জানা গেল না! অনশনের মধ্যেই এ দিন চেন্নাই সফরে যান প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সেই সফর নিয়ে বিশেষ কথা না বলে দিনের শেষে তাঁর দফতর জানাল, পিএমও-র চাপেই উন্নাওয়ের ঘটনা সিবিআইয়ের হাতে গিয়েছে। কংগ্রেসের প্রশ্ন,
যে মোদী সব কিছু নিয়ে নিজের ছবি প্রচার করেন, তিনি কি আজ রাহুলের চাপেই নিজের অনশনের ছবি দিলেন না?
আসিফা-কাণ্ডে এই প্রথম মুখ খুলল মোদী সরকার
ওই ঘটনা নিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এত দিন মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও এ দিনই প্রথম সরকারের তরফে মুখ খোলেন বিদেশ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী ভি কে সিংহ। টুইট করে তিনি বলেন, ‘‘মানুষ হিসাবে আমরা আসিফাকে বাঁচাতে পারিনি। কিন্তু বিচার থেকে বঞ্চিত হবে না ওই শিশুটি।’’
এ ঘটনা নিয়ে এত দিন বিক্ষোভের আঁচ সে ভাবে গোটা দেশে পৌঁছয়নি। বৃহস্পতিবার বিদেশ প্রতিমন্ত্রী ভি কে সিংহ টুইট করেন, ‘‘আসিফাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হলাম। কিন্তু বিচার ওকে পাইয়ে দিতেই হবে।’’ বিজেপি সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রথম কেউ আসিফা-কাণ্ডে মুখ খুললেন। বরং ঘটনায় অভিযুক্তদের পক্ষ নিয়ে সরব হতে দেখা গিয়েছে বিজেপির সমর্থনপ্রাপ্ত ‘হিন্দু একতা মঞ্চ’কে।
গত মাসেই আর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ (তিনি আবার সংসদে কাঠুয়ারই প্রতিনিধি) ধর্ষণে অভিযুক্তের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘‘যারা অপরাধ করেনি, তাদের বিচার মেলা উচিত।’’
তদন্তে জানা গিয়েছে, স্থানীয় একটি মন্দিরে বেশ কয়েক দিন ধরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল আসিফাকে। ঘুমের ওষুধ দিয়ে আচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছিল। চার্জশিটে লেখা হয়েছে, ‘দিনের পর দিন ধরে ধর্ষণ করা হয় আসিফাকে। অত্যাচার করা হয়। আর শেষে খুন করা হয়।’ শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছিল আসিফাকে। মাথায় পাথর দিয়ে দু’বার আঘাতের চিহ্নও মিলেছিল ময়নাতদন্তে। চার্জশিটে বলা হয়েছে— সুরেন্দ্র বর্মা, আনন্দ দত্ত, তিলক রাজ ও খাজুরিয়া নামে চার পুলিশ অফিসারকে নিয়ে গোটা ষড়যন্ত্রটি করেছিল সঞ্জি রাম নামে এক ব্যক্তি।
তদন্তে জানা গিয়েছে, খাজুরিয়া-সহ ওই পুলিশ অফিসাররাই আসিফার পরিবারকে নিয়ে তার দেহ খুঁজতে বেরিয়েছিল। এমনকি আসিফার মা-বাবা যখন থানায় অভিযোগ জানাতে এসেছিল, এদেরই কেউ এফআইআর দায়ের করে। প্রমাণ লোপাট করতে আসিফার রক্ত আর কাদামাখা জামা ধুয়ে তার পর ময়নাতদন্তে পাঠিয়েছিল এরাই।
জম্মু-কাশ্মীরের ভবঘুরে বকারওয়াল সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত আসিফার পরিবার। এঁরা মূলত মেষপালকের কাজ করে দিন গুজরান করেন। বিক্ষুব্ধদের একাংশের দাবি, সংখ্যালঘু এই সম্প্রদায়কে উপত্যকা-ছাড়া করতেই এমন নৃশংস কাজ করা হয়েছিল। কাঠুয়া-কাণ্ডে বিজেপি-যোগ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। সম্প্রতি অভিযুক্তদের সমর্থনে মিছিল বেরোয়। তাতে মেহবুবার মন্ত্রিসভার দুই বিজেপি সদস্যকেও দেখা গিয়েছিল। মেহবুবা মুফতি অবশ্য বকারওয়াল সম্প্রদায়ের দাবি মেনে সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার তুলে দিয়েছেন।
0 comments: