গুয়াহাটি : প্রতি বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর শীতের মৌসুমে সাইবেরিয়া, কাম্বোডিয়া, ম্যানমার প্রভৃতি ঠাণ্ডা অঞ্চল থেকে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি অসম তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন উষ্ণ অঞ্চলে এসে কয়েক মাস সময় কাটিয়ে যায়। তাদেরই এক বৃহৎ অংশ অসমের ডিমা হাসাও জেলার সদর শহর হাফলং থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ী অঞ্চল জাটিঙ্গার বিভিন্ন বনে-বাদাড়ে, পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেই। আশ-পাশের চোরা শিকারিরা ওঁত পেতে থাকে। রাতে তীব্র আলো জ্বলিয়ে নানাভাবে ফাঁদ পেতে যাযাবর পাখিগুলোকে ধরে। বৃষ্টি স্নাত, অল্প মেঘ, কুয়াশা ঢাকা ঠাণ্ডায় পাখিগুলো সাধারণত আসে।
প্রকৃতিপ্ৰেমী অমল গুপ্তর লেখা ‘আত্মঘাতী পাখি’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, জটিঙ্গা অঞ্চলের সুউচ্চ পাহাড়ে চুম্বক জাতীয় এক পাথর আছে। এছাড়াও স্ফটিক স্বচ্ছ এক পাথরও দেখা যায়। হাজার হাজার কিলোমিটার দূর থেকে আসা যাযাবর তৃষ্ণাত্ব পাখিগুলো স্ফটিক স্বচ্ছ পাথরগুলিকে জলাশয় ভেবে নীচে নেমে আসে। দ্বিতীয়ত, চুম্বকের আকর্ষণে পাখিগুলোর অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করা যায়। বৃষ্টি স্নাত পাখিগুলো থর-থর করে কাঁপতে থাকে। তাদেরকে যত্ন করে খাওয়ালেও খাদ্য মুখে তোলে না। এভাবেই অধিকাংশ পাখি মারা যায়। পাখিগুলোর দুরবস্থার সেই সুযোগ নেয় চােরা শিকারিরা। কোনও পাখিই স্ব-ইচ্ছায় আত্মহত্যা করে না। প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতির শিকার এই পাখিগুলোকে হত্যা করে। হাফলং-জাটিঙ্গার বিভিন্ন বাজারে, হােটেলগুলিতে বিক্রি করে। শেষ পর্যন্ত অতিথি পাখিগুলো হােটেলের প্লেটে সু-স্বাদ মাংস হিসেবে স্থান পায়।
জাটিঙ্গায় পাখিরা স্ব-ইচ্ছাই আত্মহত্যা করে, এই ধারণার প্রেক্ষিতে জটিঙ্গা সারা বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বের পর্যটকরা এই মৌসুমে হাফলং-জাটিঙ্গায় ভীড় জমায়। এবারও জটিঙ্গায় পাখি আসা শুরু হয়েছে। এক বিদেশি পর্যটক স্থানীয় এক চা-বাগানের কর্মকর্তার সঙ্গে যোগ-সাজোস করে তথ্য চিত্র তৈরি করছেন এবং বহু যাযাবর পাখি মেরেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে “পিপল ফর আ্যনিমেলস’-র সর্বভারতীয় সভানেত্রী মেনকা গান্ধী ডিমা হাসাও জেলার ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করে অবিলম্বে পাখি হত্যা বন্ধের দাবী জানিয়েছেন।
রাজ্যের বন মন্ত্রী প্রমীলারাণী ব্ৰহ্ম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে অসহায়তার সঙ্গে বলেছেন, জাটিঙ্গা স্ব-শাসিত ডিমা হাসাও জেলা পরিষদের অন্তৰ্ভুক্ত। তাই তাদের সেখানে হস্তক্ষেপ করাটা অসুবিধা। তবে রাজ্যের চিফ কনজারভেটার অফ ফরেষ্টকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, বাইরের কোনও পর্যটক সেখানে গিয়ে পাখি হত্যা যেন না করে। রাজ্যে সরকারের এই নির্দেশের প্রেক্ষিতে ডিমা হাসাও জেলা প্রশাসন জাটিঙ্গার আশ-পাশ অঞ্চলে ১৪৪ ধারা জারি করেছেন অস্ত্ৰ-শস্ত্র, যে কোনও ধরণের ফাঁদ, টিচ লাইট, তীব্র আলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
রাজ্যের বিশিষ্ট প্রকৃতি প্রেমী তথা বরাক উপত্যকার কমিশনার ডঃ আনোয়ার উদ্দিন চৌধুরী জটিঙ্গার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি তার অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে বলেন, দেশান্তরি পাখিগুলো এখন জাটিঙ্গা ছেড়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে একটি গ্রামে আশ্রয় নিচ্ছে। তাদেরকে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার দায়িত্ব গ্রামবাসীর। মনে রাখতে হবে তারা আমাদের অতিথি ।
0 comments: