ওরিজিনাল ইনহ্যাবিটেন্টকে ঘিরে দুশ্চিন্তায় রাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষ

এন আর সি খসড়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর অভয় বাণী : ভয় পাওয়ার কিছুই নেই 

অমল গুপ্ত, গুয়াহাটি : 
প্রায় তিন কোটি ত্ৰিশ লাখ জনসংখ্যাকে নিয়ে অসমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এন আর সি)র কাজ শুরু হয়েছে। যা প্ৰায় শেষ পৰ্য্যায়ে। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে খসড়া তালিকা প্রকাশ পাবে। ছয় কোটিরও বেশি নথিপত্র পরীক্ষা করে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। ১৯৫৫ সালে নাগরিকত্ব আইনের ৬ (এ) ধারা মেনে এবং ২০০৩ সালের সিটিজেনশ্বিপ (রেজিষ্ট্রেশন অফ সিটিজেনস এ্যাণ্ড ইস্যু অফ আইডেনটিটি কার্ড) আইন মেনে নাগরিকত্ব নবায়নের কাজ চলছে। অসম চুক্তির আধারে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের মধ্যরাত পৰ্য্যন্ত এই রাজ্যে আসা নাগরিকদের নিয়ে এন আর সির কাজ শুরু হয়েছে। এন আর সি কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে— নিরপেক্ষ, তথ্যভিত্তিক এবং বৈষম্যবিহীন এন আর সি প্রস্তুত করা হবে। এই কথাও বলেছে— ওরিজিনাল ইনহ্যাবিটেন্ট বা আদিবাসিন্দা বলে কোনও শ্রেণীবিভাজন করা হবে না। বহিঃরাজ্যের যে সব মানুষ রুজি রোজগারের স্বার্থে এই রাজ্যে এসে বছরের পর বছর ধরে বসবাস করছেন, তাদের নাম এন আর সিতে অন্তর্ভুক্ত হবে কি না, সেই ব্যাপারে উচ্চবাচ্চ্য করেন নি এন আর সি কর্তৃপক্ষ। রাজ্যে নাগরিকপঞ্জি নবায়নের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ চলছে, অপরদিকে অসম-বাংলাদেশ সীমান্তের ২৬৩ কিলোমিটারের মধ্যে ৬১.৫ কিলোমিটার উন্মুক্ত হয়ে আছে। তার মধ্যে জল সীমান্ত হচ্ছে ৪৮.১১ কিলোমিটার। নিম্ন অসমের বৃহত্তম জেলা ধুবুরী-বাংলাদেশ সীমান্তে নদী পথ দিয়েই অবৈধ অনুপ্রবেশ, চােরা চালান, জাল নােট, প্রভৃতি অপরাধজনিত ঘটনার সংখ্যা বেশি বলে সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনীর (বি এস এফ) দাবী। ওরিজিনাল ইনহ্যাবিটেন্ট বা আদি ভূমিপুত্র কারা? সেই ব্যপারে আজও সংজ্ঞা নির্ণয় হয়নি। অসম চুক্তির অন্যতম ধারা ছিল সীমান্ত সীল করতে হবে এবং অসমীয়াদের সংজ্ঞা নির্ণয় করতে হবে। অসম চুক্তি ৰূপায়নে তিন দশক অতিক্রান্ত আজও সীমান্ত সীল হল না। নাগরিকত্বের ভিত্তি বছর ১৯৫১ হবে না। ১৯৭১ সাল হবে তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে মামলা চলছে। অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে অসম সন্মিলিত মহাসংঘ। ১৯৫১ সালকে ভিত্তি বছর করার দাবীতে সুপ্রিম কোর্টে দ্বারস্থ হয়েছে। অসম প্রদেশ কংগ্ৰেছ কমিটি ওরিজিনাল ইনহ্যাবিটেন্ট চিহ্নিতকরণের বিরোধিতা করে বলেছে খিলঞ্জিয়ার (ভূমিপুত্ৰ) সংজ্ঞা নির্ণয় প্রথমে করতে হবে। এনআরসি কর্তৃপক্ষ ওরিজিনাল ইনহ্যাবিটেন্ট বলে শ্রেণীবিভাজন করা হবে না। বলে দাবী করলেও ২০০৯ৰ সালের সংশোধিত নাগরিকত্ব (নাগরিকের পঞ্জিকরণ এবং জাতীয় পরিচয় পত্ৰ প্ৰদান বিধির ৪ (এ) অনুসূচীর ৩ (এ) ধারায় ওরিজিনাল ইনহ্যাবিটেন্ট (ওআই) বিষয়টি রয়েছে। এন আর সি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে এন আর সি তালিকায় যাদের নাম বাদ পড়বে তারা ৩০ দিনের মধ্যে নাম অন্তৰ্ভক্তের দাবী জানাতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল কড়া ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, এন আর সির কাজে যে বাধা দেবে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত করা হবে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কোনও বৈধ ভারতীয় নাগরিকের নাম এন আর সি থেকে বাদ দেওয়া হবে না। মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকে ঘিরে রাজ্যের সংখ্যালঘু ভাষিক ধমীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয় ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। দেশের রেজিষ্টার জেনারেল অফ ইণ্ডিয়া (আর জি আই) প্রধান শৈলেশ, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরের যুগ্ম সচিব সত্যেন্দ্ৰ গৰ্গ এবং এন আর সি প্রধান প্রতীক হাজেলা রাজ্যের আসু, আমসু, বরাক উপত্যকা বিভিন্ন সংগঠনসহ প্রায় ২৯ টি সংগঠনের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করলেন গুয়াহাটিতে। সেই দীর্ঘ বৈঠকে সংগঠনের মধ্যে বিভাজন লক্ষ্য করা গেল। স্পষ্ট কোনও সিদ্ধান্তের কথা জানা গেল না। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এন আর সি খসড়া প্রকাশ পাবে। ইতিমধ্যে পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষের ইস্যু করা প্রায় ৪২ লক্ষ ধৰ্মীয়, ভাষিক সংখ্যালঘু মহিলাদের নাম গুয়াহাটি হাই কোর্ট বাতিল করে দিয়েছে। এই ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে। ৪২ লক্ষের মধ্যে অধিকাংশের নাম এন আর সির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে না, এই আশংকায় ভুগছে রাজ্যের সংখ্যালঘু বাঙালিরা। বরাক উপত্যক সংগঠনগুলো জোরাল দাবী তুলেছে করিমগঞ্জ, কাছাড়, হাইলাকান্দি এই তিন জেলা অবিভক্ত ভারতেরই অংশ ছিল। তারা সবাই ওরিজিনাল ইনহ্যাবিটেন্ট। এন আর সির খসড়া প্রকাশকে কেন্দ্র রাজ্যের শান্তি-শৃংখলা বিঘ্নিত হতে পারে। এই আশংকার প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজ্যের উচ্চ পয্যায়ের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেনা-বাহিনী এবং অর্ধ সেনা-বাহিনীকে সর্তক করে দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের এই জটিল রাজনীতিক পরিস্থিতির মাঝে ডি ভোটার এবং ডিটেনশন ক্যাম্পের সমস্যার কোনও সুরাহা দেখা যাচ্ছে না। ডি ভোটারের সংখ্যা ক্রমশঃ উর্ধমুখী। ১৪৬ হাজার ডি ভোটার ছিল। প্রতিদিনই এর সংখ্যা বাড়ছে। প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক বহুবার ভোট দিয়েছে। সঙ্গে বৈধ নথিপত্ৰ আছে। তার পরও বহু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানুষকে ডি ভোটার সাজিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পের অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বলে আমসুসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু সংগঠনগুলো অভিযোগ করেই যাচ্ছে। ৬ টি ডিটেনশন ক্যাম্পের বন্দীরা বছরের পাৰ বছর জেলে আবদ্ধ। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কোনও প্রত্যার্পণ চুক্তি নেই। এরা যাবে কোথায় ? রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল যতই অভয় বাণী দিন না কেন, কার্যত রাজ্যে ডি ভোটার, ডিটেনশ্যন ক্যাম্প, সৰ্বোপরি এন আর সি খসড়া নিয়ে সংখ্যালঘু মানুষের দুঃশ্চিন্তা ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে।

SHARE THIS

No. 1 Web Media in North-East India. Maintained and Published by Saiyad Bulbul Jamanur Hoque on behalf of Save Media Solution (A unit of SAVE).

0 comments: