দেবকিশোর চক্রবর্তী, কলকাতা :
মুকুল রায় দলের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পৃথক দল গড়বেন। পশ্চিম বঙ্গের বর্তমান শাসক দলের অন্দর মহলেও চাপা। গুঞ্জন শুরু হয়েছিল, মুকুলবাবু আলাদা দল করলে কিছুটা হলেও প্রভাব পড়বে। নিজের কর্মদোষে দলনেত্রীর এক সময়ের ছায়াসঙ্গী দলের মধ্যেই ক্রমশঃ কোণঠাসা হয়ে পড়ছিলেন। একের পর এক পদ থেকে তাকে সরিয়ে দিয়ে দলের অন্দরে ক্রমশ গুরুত্বহীন করে দেওয়া হচ্ছিল। এক সময় এই মুকুল রায়ের হাত ধরেই তৃণমূল কংগ্রেসে সামিল হওয়া দ্বিতীয় শ্রেণির নেতাদের একাংশ তো প্রকাশ্যেই তাঁর সমালোচনায় সরব হয়ে উঠেছিলেন। দিনের পর দিন এহেন অপমানে বিদ্ধ হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন দলের ‘একদা চাণক্য’ মুকুল রায়। তাঁর এহেন মৌনতায় রাজ্য রাজনীতিতে শুরু হয়েছিল বিস্তর জল্পনা৷ তখন থেকেই এ রাজ্যের সংবাদ মাধ্যমের একাংশ মুখরোচক সংবাদ প্রকাশ করে জল্পনায় ইন্ধন দিতে থাকে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উপস্থিতিতে সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন ভারতীয় জনতা পার্টিতে। তৃণমূল ছেড়ে গেরুয়া শিবিরে তাঁর সামিল হওয়ার পর থেকে আলোচনার অভিমুখ অনেকটাই বদলে গেছে।
তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য শুরু থেকেই মকুলের বিজেপিতে যোগ দেওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্বহীণ। প্রমাণ করতে উপেক্ষার পথ বেছে নিয়েছে। বঙ্গের শাসক দলের প্রথম সারির নেতাদের একাংশ তো প্রকাশ্যেই তাঁর এই দলত্যাগের বিষয়টিকে স্বার্থসৰ্বস্ব ‘ধান্দাবাজী” বলে উল্লেখ করেছেন। আবার ওই নেতাদের কেউ কেউ তো এমনও বলেছেন, “ওকে নিয়ে আলোচনা করা মানে সময় নষ্ট করা’। শাসক দলের নেতারা যে যাই বলুন না কেন, মুকুল রায়ের দলত্যাগ পশ্চিম বঙ্গের রাজ্য রাজনীতিতে কিছুটা হলেও যে প্রভাব পড়বে সেটা প্রকাশ্যে না মানলেও আড়ালে আবডালে অনেকেই মেনে নিচ্ছেন। সন্দেহ নেই বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহর সবুজ সংকেতেই মুকুলবাবুকে আনুষ্ঠানিকভাবে সামিল করানো হয়েছে গেরুয়া শিবিরে।
একই সঙ্গে দু তরফেই বেশ কিছু শর্তও অলিখিতভাবে রাখা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতমটি অবশ্যই যেন তেন প্রকারেন। পশ্চিম বঙ্গের রাজনীতিতে পট পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করা আর সেই লক্ষ্যে যত দ্রুত সম্ভব শাসক দলের শিবির ভেঙে গেরুয়া বাহিনির শক্তিবৃদ্ধি করা। এ রাজ্যের রাজনীতিক মহলের মতে, “তৃণের মুকুল আর পদ্মের মুকুলে বিস্তর ফারাক রয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। টানা চৌত্ৰিশ বছরের বাম শাসনে একমাত্র বিরোধী মুখ ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নেত্রীর শক্তিবৃদ্ধিতে সে সময় অন্যতম সৈনিক ছিলেন তিনিই। দলনেত্রীর প্রবল জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে সংগঠন বিস্তার করেছিলেন ঠান্ডা মাথার এই মুকুলবাবুই। শুধু তাই না, প্রতিবেশি রাজ্যগুলোতেও দলের প্রচার প্রসার বাড়াতে নিয়ম করে ছুটে বেরিয়েছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দলের নিচু তলার কৰ্মী ও সংগঠকদের সঙ্গে তাঁর ছিল প্রত্যক্ষ সম্পর্ক। আর তার চেয়েও বড় বিষয় হল, এই নাতিদীর্ঘ চেহারার মানুষটি অন্যদলের কমী সমর্থকদের ভাঙিয়ে নিয়ে এসে দলের আয়তন বৃদ্ধি করেছেন দিনের পর দিন। অন্য দলের কর্মীদের ভাঙিয়ে আনার খেলায় তাঁর বিকল্প পশ্চিম বঙ্গের রাজনীতিতে প্ৰায় নেই। আর তার চেয়েও বড় কথা, বাংলার প্রতিটি মহকুমা থেকে ব্লক স্তরের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের নামধাম আজও তাঁর ঠোঁটস্থ। গড়গড় করে বলে দিতে পারেন সকলের নামধাম।
সম্ভবত তাঁর এহেন গুনোপনার দিকগুলো দেখেই বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁকে স্বাগত জানিয়ে দলে নিয়ে এসেছে। তার চেয়ে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সম্ভাবতো তাঁরা প্রাধান্য দিয়েছেন। সেটি হল, মুকুল রায় এমন একটি চরিত্র যিনি দলের আগাপাশতলা চেনেন জানেন হাতের তালুর মতো। জানেন দলের গঠনতন্ত্র থেকে অন্দর মহলের বহু তথ্য। ঠিক যেমনটি জানতেন আসামের প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা ও মন্ত্রী তথা বিগত সরকারের “সেকেন্ড-ইন-কমান্ড’ হিমন্ত বিশ্ব শৰ্মা। আসামের রাজনৈতিক পালা বদলে এই তরুণত্যুকী নেতার মস্তিষ্ক টানা দু’বারের কংগ্রেস শাসনের অবসান ঘটিয়ে পদ্মমণ্ডিত করে দিয়েছে আসামকে। হাতে হাতে ফল পেয়েছে গেরুয়া শিবির। তো, এক সময় এই হিমন্ত বিশ্ব শৰ্মাও ছিলেন তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ—এর বিশ্বস্ত সহকৰ্মী। পশ্চিম বঙ্গের বর্তমান শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসে তো তারচেয়েও আরো বেশি বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন মুকুলবাবু। বিজেপির দিল্লির নেতারা অসম রাজনীতির চাণক্যর কথা স্মরণ রেখেই যে মুকুলবাবুকে দলে এনেছেন সন্দেহ নেই। তবে, একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, আসামে কিন্তু বিজেপি বহুদিন ধরেই নিজেদের আন্দোলন বহাল রেখেছিল। আর সেখানকার প্রেক্ষাপটের সঙ্গে পশ্চিম বঙ্গের পরিস্থিতিকে মিলিয়ে-গুলিয়ে ফেললে চলবে না। ভুলে গেলে চলবে না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কিন্তু শুধুমাত্র মুখ্যমন্ত্রী নন, তিনি কার্যত একজন জননেত্রী। ফলে, হিমন্ত বিশ্ব শর্মার রসায়ন আসামে সার্থক হলেও এই পশ্চিম বঙ্গে কিন্তু “মুকুলরসায়ন” তেমনভাবে সফল হবে না। দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতার ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত তো তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাঁদের অধিকাংশের মতে, কোনো অর্থেই মমতার বিকল্প মুকুল হতে পারেন না। আর সকালটা দেখলেই যেমন গোটা দিন কেমন যেতে পারে তার একটা আভাস মেলে, মুকুল রায়ের দল বদল পরবৰ্তী পরিস্থিতি থেকে মোটামুটি আপাত স্পষ্ট হয়েছে, মুকুল প্রাপ্তি’তে বিজেপির আখেরে খুব সুবিধা হবে না। মুকুলবাবুর একদা ছায়াসঙ্গিনী মেদিনীপুরের তৃণমূল বিধায়ক বলেছেন, উনি দল ছেড়েছেন বলে আমার সে প্রশ্নই নেই। আমার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর সাথেই ছিলাম এবং থাকবও। সে রক্ত বিন্দু পর্যন্ত তাঁর পাশেই থাকব। প্রায় একই কথা বলেছেন স্বয়ং মুকুলপুত্র বিধায়ক শুভ্ৰাংশু রায়ও। তিনি যেমন বলেছেন, “আমার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি বিজেপি চিনি না। দল পরিবর্তণ করার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা।”
0 comments: