তিন তালাকের জবর গোরো

  • মিলন দত্ত , কলকাতা

মুসলমানের ‘মসিহা’ হয়েছেন মোদী। ভারতীয় মুসলমানের সমাজ সংস্কারক হিসেবে অবতীর্ণ ভারতীয় জনতা পার্টি। সাম্প্রতিক কালে কি এর চেয়ে বড় তামাসা কেউ দেখেছে? মুসলমান নারীর মঙ্গল চেয়ে আইন করছে বিজেপি সরকার! কাঁঠালের আমসত্ত্বও বোধহয় এর চেয়ে বাস্তব। মাত্র সাতটি ধারা বিশিষ্ট ওই বিলের মতো এত সংগতিহীন, অসম্পূর্ণ এবং দায়সারা বিল সংসদে সম্ভবত এর আগে কখনও পেশ হয়নি। 
এই বিল তৈরি করে বিজেপি হয়তো মুসলিম বিরোধী হিন্দু ভোটারদের সমর্থন অনেকটাই এককাট্টা করতে পারবে, তবে এ দিয়ে মুসলমান নারীর যে কোনও মঙ্গল হবে না, তা বিলটিতে একবার চোখ বোলালেই বোঝা যাবে। তার জন্য আইন বিশেষজ্ঞ হতে হবে না। কি আছে ওই বিলে? বিলের পুরো ‌নাম ‘দ্য মুসলিম উইমেন (প্রোটেকশন অব রাইটস অন ম্যারেজ) বিল ২০১৭’। 
আসলে এটা ১৯৮৬ সালে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর আমলে তৈরি মুসলিম মহিলা আইনে ক্ষুদ্র সংযোজন মাত্র। বিলটি শুধুমাত্র ‘তালাক-এ-বিদ্দত’ বা তাৎক্ষণিক তিন তালাক (একসঙ্গে তিন বার তালাক উচ্চারণ করে সঙ্গে সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ)-এর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। বিলটি আইনে পরিণত হলে তাৎক্ষণিক তিন তালাক জামিন অযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে। এই আইনে মৌখিক, লিখিত বা ইলেকট্রনিক (ইমেল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, স্কাইপ ইত্যাদি) পদ্বতিতে তিন তালাক দেওয়া বেআইনি বা অচল বলে গণ্য হবে। বিলে তিন তালাক ঘোষণায় দোষী স্বামীর তিন বছরের কারাবাস এবং জরিমানার বিধান রয়েছে। স্বামীর জেল হওয়ার পরে পরিত্বক্তা স্ত্রীর খোরপোশ কে দেবে? সন্তানের ভরনপোষণের দায়িত্ব কি সরকার নেবে? বিলে তার কোনও উল্লেখ নেই। বিবাহবিচ্ছেদের মতো একটা দেওয়ানি বিষয়কে ফৌজদারি আইনের আওতায় নিয়ে যাওয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত সেই প্রশ্ন কংগ্রেসের সঙ্গে গলা মিলিয়ে অনেকেই তুলেছেন। বাংলার মুসলমানের আরেক ত্রাতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার বলেছেন, ‘বিজেপির এই ত্রুটিপূর্ণ বিলের মাধ্যমে মহিলাদের সুরক্ষা দেওয়া তো দূরের কথা, উল্টে বিপদ আরও বেড়ে যাবে।’ মহিলাদের কি বিপদ কীভাবে বাড়বে এবং কি তার সুরাহা সে সবের মধ্যে যাননি মমতা। যাননি, কারণ তিনিও বিজেপির মতোই মুসলমানের কোনও প্রকৃত সমস্যার সমাধান চান না। তাই আসল সমস্যাটা নিয়ে কিন্তু কেউই কথা বলছে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোড়া থেকেই কাটমোল্লাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তিন তালাক প্রথা বহাল রাখার পক্ষে সওয়াল করেছেন। 
মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, মুসলমানরা তার স্ত্রীকে কীভাবে রাখবে বাখবে কি রাখবে না, তা অন্য কেউ ঠিক করে দিতে পারে না। মুখ্যমন্ত্রীর ‘অনুপ্রেরণা’য় তাঁর এক বড়োসড়ো মন্ত্রী উলোমাদের ডাকা এক জনসভায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, আমার বৌকে আমি রাখব না তাড়িয়ে দেব সেটা কি কেন্দ্র সরকার ঠিক করে দেবে? সেই তৃণমূল কংগ্রেসই লোকসভায় ভোটাভুটির সময় গরহাজির থেকে বিলটিকে কার্যত সমর্থন করছে। মোদীকে সমর্থন করার সেই বার্তা মুসলমান সমাজের কাছে পৌঁছেনোর পরে ত্রুটি শুধরে নিতে রাজ্যসভায় তারা অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়। রাজ্যসভায় সেই তৃণমৃলই লোকসভার একেবারে উল্টো ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। 
এই সময় মুসলমান সমাদের নেতারা কি করলেন? তাঁরা তিন তালাকের সমর্থনে ফের দাবি জানালেন, মুসলমানের ব্যক্তিগত আইনে হাত দেওয়া যাবে না। জেনে রাখা দরকার, মুসলিম বিবাহ একটি লিখিত চুক্তি— হিন্দুর মতো প্রজাপতি নির্বন্ধ বা সাত জনমের বন্ধন নয়। মুসলিম সমাজে বিয়ের আগে কনেকে দেয় দেনমোহরের লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। কনেকে কতটা (স্থাবর বা অস্থাবর সম্পদে) দেনমোহর বা স্ত্রীধন দেওয়ার হবে তা ঠিক হওয়ার পরেই বিয়ের কথা পাকা হয়। তিন তালাক বা যে কোনও রকমের বিবাহবিচ্ছেদের আগে প্রতিশ্রুত দেনমোহর স্ত্রীকে দিয়ে দিতে হবে। এটাই বিধি। বিজেপি সরকারের তৈরি নতুন আইনে দেনমোহরের কোনও উল্লেখ পর্যন্ত নেই। অথচ তালাক সম্পন্ন করার আগে স্ত্রীর প্রাপ্য দেনমোহর ফিরিয়ে দেওয়া বাধ্যতামূলক। দেনমোহরের উল্লেখ ছাড়া কোনও মুসলিম বিবাহ আইন সম্পূর্ণ হতে পারে না। তাছাড়া তালাক দিলে স্বামীকে জেলে ভরার বিধান দেওয়া হলেও বিবাহবিচ্ছিন্না স্ত্রী এবং সন্তানদের ভরনপোষণের বিষয়টা পরিস্কার করা হয়নি। বলে হয়েছে, নাবালক সন্তানের দায়িত্ব পাবেন তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী। খোরপোষ বা ভরণপোষণের উল্লেখ থাকলেও তা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেরর বিবেচনার ওপর। কিসের নিরিখে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী কত টাকা খোরপোষ পাবেন তা উল্লেখ করা হয়নি আইনে। 


মুসলমান মেয়েদের প্রকৃত ভাল চাইলে সরকার এবং বিরোধীরা সম্মিলিত ভাবে কোরানের বিধান মেনে মুসলিম বিবাহ ব্যবস্থাকে ভারতীয় আইনের আওতায় নিয়ে আসাতে উদ্যোগী হত। যেমনটা অনেক দিন আগেই হয়েছে বিশ্বে অধিকাংশ মুসলিম দেশে। কোরানে বিবাহবিচ্ছেদের যে বিধান রয়েছে তা তিন মাসের একটি প্রক্রিয়া এবং রীতিমতো জটিল। সেটা করলে আজ ঘটা করে তিন তালাক নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন হত না। মুসলিমদের বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে কোরান কথিত মান্য পদ্ধতিকেই যদি তালাকের একমাত্র পদ্ধতি হিসেবে আইন করা হত তাহলে তাৎক্ষণিক তালাক আপনাআপনিই বিলুপ্ত হত। মুসলিম ব্যক্তিগত আইন শুধুই কোরান মেনে তৈরি হয়েছে এমন দাবি করা যাবে না। বরং তা শরিয়ত অনুসারী। কোরান ও হাদিসের যৌথ বিধিবিধান হল শরিয়ত। মুসলমানদের বিশ্বাস, শরিয়ত হল সম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থা। রাষ্ট্র পরিচালনা, বিচারব্যবস্থা থেকে ব্যক্তিগত জীবনের যাবতীয় সমস্যা ও প্রশ্নের সমাধান রয়েছে শরিয়তে। এবং শরিয়ত অলঙ্ঘনীয় এবং অপরিবর্তনীয়। 
শাসনকাজ পরিচালনার জন্য উম্মায়িদ ও আব্বাসিয় খলিফাদের যুগে প্রচলিত শরিতয় আইন বিভিন্ন সময়ে নানা ভাবে পরিবর্তন হয়েছে। এসব পরিবর্তনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, খলিফাদের শাসনকে শক্তিশালী করা ও তাদের সব ধরনের রাজকীয় রীতিনীতিকে ধর্মীয় গ্রহণযোগ্যতা দেওয়া। কোরানকে আইন হিসেবে অগ্রাধিকার দিলে এক বৈঠকে তিন তালাক (তালাক-এ-বিদ্দত) কোনও ভাবেই বৈধতা পায় না। কিন্তু এ দেশে মুসলিম পুরুষের গভীর ভরসা তিন তালাকের ওপর। অভিন্ন দেওয়ানি আইনের প্রশ্নই নেই। অভিন্ন বিধির নামে সরকার নাকি মুসলমানের ঘাড়ে হিন্দু ব্যক্তিগত আইন চাপিয়ে দেবে। কিন্তু ঠিক উলটো অবস্থান মুসলমান সমাজের মেয়েদের। তিন তালাকের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে মুসলমান নারী শরিয়ত নিয়ন্ত্রিত মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের সংস্কার চায়েছেন। ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন নামে মুম্বইয়ের একটি সংগঠনের করা ২০১৫ সালের একটি সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, পশ্চিমবঙ্গ সহ দশটি রাজ্যে প্রায় ৫ হাজার মহিলার ৮৩.৩ শতাংশ শরিয়ত আইনের সংস্কার চেয়ে মত প্রকাশ করেছেন। এক বৈঠকে তিন বার তালাক উচ্চারণ করে স্ত্রীকে বিদায় করে দেওয়ার চালু প্রথার অবসান ছাড়াও বহু বিবাহ, দেনমহর এবং দত্তক সংক্রান্ত যাবতীয় শরিয়তি বিধানকে বিচার বিভাগ এবং সরকারি প্রশাসনের আওতায় এনে বিধিবদ্ধ ব্যক্তগত আইন চান ওই মহিলারা। বস্তুত ভারত ছাড়া বিশ্বের আর কোনও দেশেই আর তিন তালাক বৈধ নয়। 
অষ্টম শতকের প্রখ্যাত ইমামদে অনুসারী হিসেবে সুন্নিদের যে চারটি (মালিকি, শাফি, হানবালি এবং হানাফি) মজহাব রয়েছে তাদের মধ্যে প্রধানত হানাফিদের মধ্যেই তিন তালাক প্রথা চালু আছে। ভারতীয় উপমহাদেশ এবং মধ্য এসিয়ার কিছু দেশে হানাফিরাই বেশি। কারণ আব্বাসি খনিফারা, অটোমান শাসকেরা এবং মোঘল সম্রাটরা ছিলেন হানাফি খণ্ডসম্প্রদায়ভুক্ত। তবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরান, ইন্দোনেশিয়া বা তিউনিশিয়ার মতো মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রের মানুষ কিন্তু অনেক দিন আগেই শরিয়তি আইনের সংস্কার মেনে নিয়েছেন। ভারতের মুসলমানের মতো সেই সব দেশের মানুষ তিন তালাক বহাল রাখা বা ফিরিয়ে আনার দাবি করে না। যত অসুবিধা ভারতীয় মুসলমানদের। মুসলিম প্রধান বেশিরভাগ দেশে তালাক, বহু বিবাহ বা সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত যাবতীয় বিবাদের নিষ্পত্তি হয় দেশের আইনে। সেখানে শরিয়তের বিধানগুলো সংস্কার করে আইন তৈরি করা হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে তেমন কোনও দাবি তোলাটাই যেন দেশবিরোধী কোনও সাম্প্রদায়িক উচ্চারণ। অথচ বাংলাদেশ কবেই তালাক বিধিবদ্ধ আইনের আওতায় নিয়ে এসেচে। বাংলাদেশে কোনও ব্যক্তি তার স্ত্রীকে যেভাবেই তালাক দিন না কেন, তালাক দেওয়ার পর যত শীঘ্র সম্ভব সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ বা পুরসভার চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত নোটিশ দিতে হবে। সেই নোটিশের একটি কপি স্ত্রীকেও দিতে হবে। কোনও ভাবে এই নিয়ম লঙ্ঘন করলে এক বছর পর্যন্ত কারাদন্ড অথবা ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা দুটো শাস্তিই হতে পারে। 
তালাকের ইচ্ছা প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে নোটিশ না দিলে তালাক বাতিল বলে গণ্য হবে। নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে উভয়পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়ার জন্য চেয়ারম্যান একটি সালিশি পরিষদ গঠন করবেন। সালিশি পরিষদ উভয়কে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতি ৩০ দিনে একটি করে মোট তিনটি নোটিশ দেবে। এর মধ্যে স্বামী তালাকের নোটিশ প্রত্যাহার না করলে তালাক কার্যকর হবে। স্বামী নোটিশ প্রত্যাহার করলে তালাক হবে না। তালাক দেওয়ার সময় স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে তালাক কার্যকর হবে না। তবে সন্তান প্রসব হওয়ার পর পর্যন্ত নোটিশ বহাল রাখলে ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হবে। ১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইন ৭ (৬) ধারা অনুযায়ী তালাকের মাধ্যমে কোনও বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলে, তালাক হওয়া দম্পতি আবার বিয়ে করতে চাইলে নতুন করে বিয়ে করতে পারেন। তার জন্য ‘হালালা’ বিয়ের কোনও প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ এমনকী কোরান নির্ধারিত হালালা বা হিল্লা বিয়েও নিষিদ্ধ করেছে। হালালা বিয়ে একজন নারীর জন্য ভয়ানক অপমানের এবং লজ্জার। এত সব ধর্মীয় সংস্কারের জন্য বাংলাদেশের মানুষকে অনেক অনেক বন্ধুর পথে হাঁটতে হয়েছে। শরিয়তের বিধান সংস্কার করে পাকিস্তান আমলেই ‘মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১’ তৈরি হয়। 
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সেই আইনের আরও সংস্কার করে ‘মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিষ্টেশন আইন, ১৯৭৪’ তৈরি হয়। বাংলাদেশে মেয়েরাও আইন সম্মতভাবে স্বামীকে তালাক দিতে পারেন। তালাকের এই উদ্ধতিকে বলা হয় ‘খুলা তালাক’। সে ক্ষেত্রে দেনমোহরের অর্থ বা সম্পদের দাবি প্রত্যাহার করে তালাক নিতে হয়। ২০০৮ সালে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে বাংলাদেশে পুরুষদের চেয়ে নারী তালাক চাইছেন বেশি। আমাদের দেশে মুসলিম মহিলাদের এমনই দশা যে খুলা তালাক কার্যকর করা দূরুহ। বস্তুত ভারত ছাড়া বিশ্বের আর কোনও দেশেই তিন তালাক ব্যবস্থা চালু নেই। তার জন্য তিন তালাকের মতো মধ্যযুগীয় নারীবিদ্বেষী প্রথা আলাদা করে বাতিল করতে হয়নি। বিশ্বের বেশিরভাগ মুসলমান দেশেই এখন বিবাহবিচ্ছেদ চেয়ে আদালতের যেতে হয়। কিংবা বিধিবদ্ধ আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে তালাক সম্পন্ন হয়। পুরুষ এবং নারী যে কেউ সেখানে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে পারে। একমাত্র ভারতেই মুসলমান সমাজ মধ্যযুগের শরিয়তে বাঁধা পড়ে আছে। সে বাঁধন থেকে তারা বেরতেও রাজি নয়। তথাকথিত সেই বাঁধন যেন তাদের অধিকার। তবে আমাদের কাছে এমন কোনও তথ্য নেই যা দিয়ে বলা যাবে গোটা মুসলমান সমাজে তিন তালাকের তেমন কোনও প্রবণতা আছে। প্রবণতা তো নয়ই বরং সমাজের একটু গভীরে গেলে দেখা যাবে যদি প্রবণতা হয়েও থাকে তা সীমাবদ্ধ কোনও একটি আর্থ-সামাজিক অবস্থার মানুষের মধ্যে। তারা কারা? মুর্শিদাবাদে একই গ্রামে দেখেছি, দরিদ্র নিরক্ষর কিছু কিছু গ্রামে প্রায় ঘরে ঘরে তালাক, অথচ শিক্ষিত এবং সম্পন্ন একটি পরিবারেও তালাক নেই। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? এ রাজ্যের মুসলিম সমাজে ওই অক্ষরহীন দরিদ্র এবং সরকারি সুযোগের নাগালের বাইরে থাকা মানুষের সংখ্যাই অধিক। 

দুর্ভাগ্যের হলেও তারাই তো বাংলার মুসলিম সমাজের মুখ। আবার তালাক যারা দিতে চায় শরিয়তি আইন তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা করে দেয়। আর তালাকের নামে শরিয়তের ভ্রান্ত ও মিথ্যা প্রয়োগকে বৈধতা দেওয়ার জন্য গ্রামে গ্রামে মৌলবি মৌলনারা আছেন। সেই কথাটাই স্পষ্ট করে বলেছেন মুর্শিদাবাদে নারী আন্দোলনের এক উজ্জ্বল মুখ খাদিজা বানু, “শরিয়তের নাম করে গ্রামের মোল্লা-মোড়লরা যে ফতোয়া দেন সেটাই মেনে নিতে হয় গ্রামের হতভাগ্য মেয়েদের। স্বামী ‘তালাক’ বলার পরে ওই স্ত্রী সাধারণত বিধান জানতে মোল্লা বা মোড়লের কাছে যান। মোড়ল বলেন, ‘স্বামীর মুখ থেকে তালাক যখন বেরিয়েছে তখন চলেই যাও’। ধর্মের নামে এই চলছে।” যে কোনও অবস্থায় পরপর তিন বার তালাক উচ্চারণ করলেই বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ। তাহলে তালাক হবে কেমন করে? প্রথমেই জেনে রাখা দরকার, ইসলামে তালাক কোনওভাবেই উৎসাহিত করা হয়নি। হজরত মুহম্মদের (সগির হাদিস) পরামর্শ ছিল, ‘তোমরা বিয়ে কর কিন্তু তালাক দিয়ো না। কেননা তালাক দিলে আল্লার আরস কেঁপে ওঠে।’ কোরানে (সুরা তালাক ৬৫:১) বলা হয়েছে, ‘হে নবি! তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের তালাক দিতে চাইলে ইদ্দতের প্রতি লক্ষ রেখে ওদের তালাক দিও। তোমরা ইদ্দতের হিসাব রেখ।... তোমরা ওদেরকে বাসগৃহ থেকে বের করে দিও না। আর ওরাও যেন বের হয়ে না যায়, যদি না ওরা স্পষ্ট অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়।’ কোনও স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করার পরের তিন মাস হল ‘ইদ্দত’। ওই সময়ের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর নিজেদের বিরোধ মিটিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে। তালাকপ্রাপ্ত মহিলা গর্ভবতী কিনা তা নিশ্চিত করার জন্যই ইদ্দত। 
কোরানে (সুরা বাকারা ২:২২৮) আছে, ‘তালাকপ্রাপ্তা নারীগণ তিন রজঃস্রাবকাল প্রতীক্ষায় থাকবেন’। ওই সুরাতেই (২:২৪১) পরে বলা হয়েছে, ‘তালাকপ্রাপ্তা নারীদের বিধিমতো ভরণপোষণ করা সাবধানীদের কর্তব্য।’ কেবল ইদ্দত কালে নয় তালাকের পরেও স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব স্বামীর। কিন্তু কোরানের এই নির্দেশ মেনে তালাক দেওয়া বা ইদ্দত কালের জন্য অপেক্ষা করা কিংবা সেই সময় ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়ার ঝামেলায় কেউ যায় না। নিয়ম হল, প্রথম এবং দ্বিতীয় বার তালাক বলার পরেও স্বামী চাইলে তৃতীয় বার তালাক বলা থেকে বিরত থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ রদ করতে পারেন। শরিয়ত বলছে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ হলে প্রথমে নিজেরা এবং পরে দু’জন মধ্যস্থতাকারীর উপস্থিতিতে আলোচনা করে সেই বিবাদ মিটিয়ে নিতে হবে। বিবাদ না মিটলে স্বামী তাঁর স্ত্রীকে প্রথম বার তালাক দেবেন (পড়ুন, বলবেন)। কিন্তু পরের তিন মাস (ইদ্দত কাল) একসঙ্গে বাস করবেন এবং অপেক্ষা করবেন বিবাদ মিটিয়ে নেওয়ার জন্য। ওই সময়ে তাঁদের বিবাদ মিটে গেলে তাঁরা আগের মতোই স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকবেন। আর বিবাদ না মিটলে তিন মাস পরে তালাক সম্পন্ন হবে। তালাক হয়ে যাওয়ার পরে স্বামী-স্ত্রী ভুল বুঝতে পেরে যদি আবার এক সঙ্গে থাকতে চান তাহলে বিরাট বিপদ। ওই স্ত্রীকে আবার অন্য এক পুরুষকে বিয়ে করে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে অন্তত চার মাস কাটানোর পরে সেই পুরুষ যদি নিয়ম মেনে তালাক দেন তবেই ওই মহিলা আবার তাঁর আগের স্বামীর কাছে ফিরে যেতে পারবেন। এই পদ্ধতিকে বলে ‘হালালা’। 
কোরানে এই নিয়ে নির্দেশ থাকলেও ‘হালালা’ প্রথা অনেক মুসলিম প্রধান দেশেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোরান বা হাদিসে যাই থাক, বাস্তবে তা হয় না। এ রাজ্যে স্বামী স্রেফ মুখের কথায় স্ত্রীকে একতরফা ভাবে ত্যাগ করছে। ‘তালাক’ শব্দটা তিনবার উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর সমস্ত বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। পোস্টকার্ডে লিখে, ই-মেল করে এমনকী এসএমএস করেও তালাক হয়ে যাচ্ছে। শরিয়তের নামে এই অমানবিক কাজ করেই চলেছে কিছু মানুষ। তালাক নিয়ে মুসলমানদের মধ্যেই নানা রকমের বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এই ব্যাপারে মুসলমান সমাজেরই কিছু কিছু মহিলা এবং মহিলাদের সংগঠন সোচ্চার হলেও পুরুষদের গলা প্রায় শোনা যায় না। তালাকের ব্যাপারে শরিয়তের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন সংস্কারের দাবি ওঠে না। বরং এ দেশে শরিয়তি আইনের প্রাচীন বিধিগুলো অবিকৃত ভাবে প্রয়োগ করার ব্যাপারেই মুসলিম নেতারা অনেক বেশি উদ্যোগী। তালাক নিয়ে শরিয়তের অপপ্রয়োগ বন্ধ করতে বাংলাদেশ এমনকী পাকিস্তানও যে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন ব্যাপকভাবে সংস্কার করেছে, সেই উদাহরণ তাঁরা কানে তুলতেই নারাজ। এর ফলে যে মুসলিম মহিলারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, শিশুরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে , সর্বোপরি গোটা মুসলমান সমাজ কলঙ্কিত হচ্ছে— সেদিকে কারও নজর নেই। এখন সেই সুযোগটাই নিচ্ছে বিজেপি। বিজেপি এখন মুসলমানের উদ্ধারকর্তা বিসেবে অবতীর্ণ। ভারতের মুসলমানের এর চেয়ে দুর্দিন আগে কখনও আসেনি। এ দেশে মুসলমানদের বিবাহ এবং তাল‌াক নিয়ে যাবতীয় বিবাদের নিষ্পত্তি হয় শরিয়ত নির্ধারিত ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন’-এ। দেশের আইন সেখানে প্রযোজ্য নয়। 
কেউ চাইলেই আইনের শরণাপন্ন হতেই পারেন। কিন্তু আদালত সে ক্ষেত্রেও তাঁদের বিচার করবে মুসলিম উইমেন (প্রোটেকশন অব রাইটস অন ডিভোর্স) অ্যাক্ট ১৯৮৬-এ। আর ওই আইনে বিবাহ বিচ্ছিন্না মহিলার ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকার স্বীকৃত নয়। কিন্তু ওই আইনের ৩ নম্বর ধারার ২ নম্বর উপধারায় বলা আছে, যদি ভরণপোষণ দাবি করে আবেদন জমা দেওয়ার পরে প্রথম শুনানির দিন বিবাহ বিচ্ছিন্না মহিলা এবং তাঁর পূর্বতন স্বামী আলাদা আলাদা করে অথবা যৌথভাবে ঘোষণা করেন যে তাঁরা ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড ১৯৭৩-এর ১২৫ থেকে ১২৮ ধারা অনুযায়ী বিচার পেতে চান এবং বিচারপতি যদি সেই আবেদন গ্রহণ করেন তাহলে সেই মহিলা ভরণপোষণ পেতেও পারেন। মুসলিম উইমেন (প্রোটেকশন অব রাইটস অন ডিভোর্স) অ্যাক্ট সংসদে পাস হয় ১৯৮৬ সালে। এই আইনেই সংগতিহীন সংযোজন করে বিজেপি আজ ভারতীয় মুসলমান সমাজের ‘সংস্কারক’! ‘তালাক-এ-বিদ্দত’ বা তাৎক্ষণিক তিন তালাক ভারত থেকে চিরতরে বিদায় করতে গেলে বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে তৈরি ‘মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন’-এর অনুসরনে একটা আইন তৈরি করা প্রয়োজন। কিন্তু বিজেপি সে পথে হাঁটেনি। অন্য কোনও রাজনৈতিক দল বা কোনও সংগঠন সে কথা মুখে আনছে না। মুসলিমদের পক্ষ থেকে আবার কেউ সে কথা বলবে না। কারণ তাঁরা ‘শরিয়ত আইন’-এর কোনও রকম লঙ্ঘন চান না। বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা বিশ্বের আর সব মুসলিম দেশে শরিয়ত ‘লঙ্ঘন’ করে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আইন প্রণয়ন করেও তাদের মুসলমানত্ব অটুট রেখেছে। আর ভারতের মুসলমান শরিয়তে নিষিদ্ধ সুদের টাকা স্বীকার করে, শরিয়ত সরিয়ে রেখে ভারতের ফৌজদারি আইন মেনে নিয়ে তারা শরিয়ত রক্ষা করতে চায় কেবল বিবাহবিচ্ছেদে। প্রবীণ সাংবাদিক হাসান সারুর তাঁর ‘ইন্ডিয়াজ মুসলিম স্প্রিং: হোয়াই নোবডি টকিং অ্যাবাউট ইট’ বইয়ে শরিয়ত ও সামাজিক সংস্কারে মাঝে ভারতীয় মুসলমানের দোদুল্যমানতা নিয়ে যে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, তার উল্লেখ এখানে প্রাসঙ্গিক হবে। সারুর বলছেন, তালাক শব্দটা তিন বার মুখে উচ্চারণ করে, লিখে জানিয়ে এমনকী এসএমএস করে স্ত্রীকে ইচ্ছে মতো ছেঁটে ফেলার একটা অমোঘ অস্ত্র মুসলমান পুরুষের হাতে শরিয়ত দিয়ে রেখেছে। মুসলমান মহিলার মাথার ওপর সব সময় ঝুলে থাকে তালাকের খাঁড়া। সেই আতঙ্কে নারী পুরুষের অনুগত থাকতে বাধ্য হয়। 
নারী বিদ্বেষী পুরুষ আর তার কাটমোল্লা সহোদরেরা তালাককে পীড়নের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে। এই আতঙ্ক থেকে মুসলমান নারীর বেরনোর একটা পথ সুপ্রিম কোর্ট করে দিয়েছিল। সামাজিক ন্যায়ের সন্ধানে রত মুসলমান মহিলাদের জন্য শাহ বানু মামলার রায় ছিল একটা মাইল ফলকের মতো। ভারতের মতো একটা সেকুলার রাষ্ট্রে ব্যক্তিগত ধর্মীয় আইনের আদৌ কোনও জায়গা থাকতে পারে কিনা তাই নিয়ে একটা জরুরি বিতর্কেরও সূচনা করে সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়। সারুরের মতে, যে মামলার রায়ে ভারতের মুসলমান নারীর দিনরাত বদলে যেতে পারত, স্রেফ উগ্র মৌলবাদী আর জঙ্গি মুসলমানদের আন্দোলনের চাপে এবং সর্বোপরি ভোটের দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি আইন তৈরি করে সেই সেই সুফল থেকে মুসলিম নারীকে বঞ্চিত করে তদানীন্তন কংগ্রেস নেতৃত্ব এবং কেন্দ্রের সরকার। শাহ বানু মামলা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন লেখক। কারণ ভারতের মুসলমানের ওই আত্মঘাতী আন্দোলন মুসলিম সমাজকে পরে কোথায় দাঁড় করায় তা বোঝার জন্যও এটা জেনে নেওয়া প্রয়োজন। মধ্যপ্রদেশে ইন্দোরের বাসিন্দা শাহ বানু ছিলেন ৬২ বছরের প্রবীণা পাঁচ সন্তানের মা। ১৯৭৮ সালে আর এক মহিলাকে বিয়ে করে শাহ বানুকে তালাক দেয়। বলাই বাহুল্য শাহ বানুর কোনও উপার্জন ছিল না। তাঁকে এবং তাঁর সম্তানদের আর্থিক সহায়তা দিতে অস্বীকার করলে শাহ বানু আদালতের দ্বারস্থ হন। 
দীর্ঘ আইনি লড়াই সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। সাত বছর পরে ১৯৮৫ সালের এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্ট তার ঐতিহাসিক রায়ে খোরপোষের নির্দেশ দেয়। ওই রায়ে বলা হয়, ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৫ নম্বর ধারায় শাহ বানুর খোরপোষ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ওই ধারা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। শাহ বানুকে মাসে সর্বোচ্চ পাঁচশো টাকা খোরপোষ দেওয়ার নির্দেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত। এই রায় কেবল একজন হতভাগ্য নারীর জয় ছিল না, বহু ধর্মের এবং বহু সংস্কৃতির এই দেশে সেকুলার আইনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার এই ছিল বহু প্রতীক্ষিত সুযোগ। এই রায়ে দেশের মুসলিম নারী আশার আলো দেখেছিল। কিন্তু সেই আশার আলো নিভে যেতে বেশি সময় লাগেনি। ওই রায় বেরনোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মৌলবাদী মুসলমানেরা বলতে শুরু করল, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় তাদের নিজস্ব পারিবারিক আইনে হস্তক্ষেপ এবং ইসলামের ওপর আক্রমণ। বলেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা হাজারে হাজারে লাখে লাখে রাস্তায় নেমে গণ্ডগোল বাধিয়ে দেয়। প্রচারটা শেষ পর্যন্ত দাঁড়ালো এই যে, সরকার মুসলমানদের ওপর অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চাপিয়ে দিচ্ছে। একে রুখতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে অল ইণ্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এবং নামি মুসলিম রাজনৈতিক নেতারা ঝাঁপিয়ে পড়ে দাবি তুললেন, নতুন কোনও আইন করে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় উল্টে দিতে হবে। চাপে পড়ে শাহ বানু বাধ্য হয়ে সাংবাদিকদের ডেকে জানিয়ে দেন, তিনি খোরপোষ পাওয়ার রায় প্রত্যাখ্যান করছেন, কারণ তা শরিয়ত বিরোধী। তারপরেও দেশজুড়ে মুসলিমদের আন্দোলন চলতেই থাকে। মুম্বইয়ে এবং গোটা দেশে ছোট বড় প্রায় সব শহরেই বিশাল মিছিল বেরোয়, ইন্দোরে কয়েক লাখ মানুষ মিছিল করে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে। তুমুল সেই বিক্ষোভ আন্দোলন চলেছিল প্রায় গোটা বছর ধরে, যতদিন না কেন্দ্রীয় সরকার আইন করে সুপ্রিম কোর্টের রায় অকার্যকর করে দেয়। রাজীব গান্ধী তখন প্রধানমন্ত্রী। প্রথমে সরকার আদালতের রায় মেনে নিলেও ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক মুসলিম নেতাদের চাপে রাজীব গান্ধী শেষপর্যন্ত নতি স্বীকার করেন। তাঁদের দাবি না মানলে পরের নির্বাচনে মুসলমানেরা কংগ্রেসকে বয়কট করার হুমকি দেয়। রাজীব গান্ধী ভয় পেয়ে সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ‘মুসলিম উইমেন (প্রোটেকশন অব রাইট অন ডিভোর্স) আইন ১৯৮৬’ পাশ করিয়ে নেন। ওই আইনের জোরে সুপ্রিম কোর্টের রায় অকার্যকর হয়ে যায়। হাসান সারুর মন্তব্য করেছেন, ‘কয়েক বছর যেতেই কংগ্রেস দল এবং মুসলমানেরা বুঝতে পারে দুই পক্ষের জন্যই কাজটা কী বিপর্যয় ডেকে এনেছে।’ তার অব্যবহিত পরেই বিজেপি প্রায় পাল্টা হিসেবে বাবরি মসজিদে বন্ধ রামলালার তালা খোলার দাবি তুললো এবং রাজীব গান্ধী দরজা খোলার অনুমতি দিলেন। তার পরিণতিতে বাবরি সমজিদ ধ্বংস, ১৯৯২-৯৩ সালের দাঙ্গা, ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা এবং আজও তার খেসারত দিচ্ছে গোটা দেশ। বলাইবাহুল্য এতে সহচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুসলমান। তারা যদি সেদিন সুপ্রিম কোর্টের সেই রায় মেনে নিত তাহলে আজ ভারতের মুসলমানকে হয়তো এই দুর্দিন দেখতে হত না। ওই আইনে তালাক দেওয়ার পরে তিন মাস পর্যন্ত (ইদ্দত পর্ব) স্ত্রী খোরপোষ পাবে। কিন্তু তার পরে কোনও খোরপোষ নয়। 

ওই তিন মাস পরে খোরপোষের দায়িত্ব বর্তাবে মহিলার আত্মীয়স্বজন এবং ওয়াক্ফ বোর্ডের ওপর। লেখক মনে করেছেন, ‘নতুন এই আইনের ফলে মুসলিম মহিলারা বৈষম্যের স্বীকার হলেন। কারণ যে আইনের বলে অন্য সব ধর্মের মহিলারা খোরপোষ দাবি করতে পারে, দেশের সেই সেকুলার আইনের পরিসর থেকে তাঁদের বের করে দেওয়া হল।’ এখন তিন তালাক রদ করার জন্য সেই আইনেই একটা সংযোজন আনতে চায় বিজেপি সরকার। অতএব এতে মুসলমান সমাজের কোন রকম মঙ্গল হবে তা ভাবার কোনও কারণ নেই। একটু ভিন্ন প্রকারে আজ ফের প্রায় একই সংকটের মুখোমুখি ভারতের মুসলমান। সেই সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তিন তালাক অসাংবিধানিক ঘোষিত। ফের মুসলমান তার প্রতিবাদ করছে— তবে যে কোনও কারণেই হোক এ বার গলায় তেমন জোর নেই। ১৯৮৫ সালের ঐতিহাসিক ভ্রান্তির পুনরাবৃত্তি কি করবে মুসলমান? না কি সে কি এ বার অন্যান্য মুসলিম দেশের মতো তালাকের জন্য কোরান নির্দেশিত বিধিবন্ধ আইন আনার দাবি তুলবে? অন্যথায় তাকে বিজেপির গড়ে দেওয়া সংগতিহীন ক্ষতিকর তথাকথিত তিন তালাক বিলকেই মেনে নিয়ে হবে। অর্ডিন্যান্স করে হোক বা যে কোনও প্রকারে বিজেপি এখন চেষ্টা করবে তাদের তিন তালাক বিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাশ করানোর। ভারতের মুসলমান ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে।

SHARE THIS

No. 1 Web Media in North-East India. Maintained and Published by Saiyad Bulbul Jamanur Hoque on behalf of Save Media Solution (A unit of SAVE).

0 comments: